বিবাহবিচ্ছেদের পর একটুও ভালো নেই ইমরান খান
স্পোর্টস ডেস্ক: মাত্র একটা প্রশ্ন লাগল ওর রাগে ফেটে পড়তে। ইমরান খানকে দেখলে সাধারণত কী মনে হয়? অসম্ভব অভিজাত এক দুঁদে চরিত্র, তেষট্টিতেও যার গ্ল্যামার এতটুকু টাল খায়নি। কিন্তু টিভি অ্যাঙ্কর কাম সাংবাদিক রেহাম খানের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ যে ওঁকে কতটা রক্তাক্ত করে ছেড়েছে, চোখের সামনে দেখলাম। দেখলাম যে, ইমরান খানও পারছেন না ভেতরের যন্ত্রণাটা লুকোতে। পারছেন না বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে চতুর্দিকের নেগেটিভ প্রচার সহ্য করতে। স্রেফ একটা প্রশ্নে ভেতরের ইমরান খান বেরিয়ে আসছে এক ঝটকায়!
ক’দিন আগে পেশোয়ারের সংবাদ সম্মেলনের কথা বলছি। একটা সিটও ফাঁকা পড়ে নেই। আর যতই বিবাহবিচ্ছেদের খবর তিন দিনের পুরনো হোক, চর্চায় মোটেও ধুলো পড়েনি। এক টিভি সাংবাদিক তার মধ্যে ইমরানকে জিজ্ঞেস করে বসল যে, রাজনৈতিক হোক বা ব্যক্তিগত জীবন — এ ভাবে লোকে আপনাকে ঠকিয়ে যায় কেন? কে কেমন লোক, আপনি কি বুঝতে পারেন না?
ব্যস। ইমরান রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠে তাঁকে পাল্টা দিলেন, ‘‘আপনি সাংবাদিক হিসেবে নিজের যোগ্যতাটা বুঝিয়ে দিলেন এই ব্যক্তিগত প্রশ্নটা করে।’’ এবং ওখানেই সংবাদ সম্মেলনের দফারফা।
আসলে রেহামের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ইমরানকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একটা বিশাল ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছে। গত সপ্তাহের স্থানীয় নির্বাচনে ওর পার্টির অবস্থা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। নওয়াজ শরিফ নিজের পার্টিকে ইমরানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে বারণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ফিসফাস, টুকটাক চিমটি কাটা, ভালো রকম চলছে। তা ছাড়া নতুন প্রজন্মও ইমরানের বিবাহবিচ্ছেদকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। ঠিক যেভাবে পারেনি ওঁর দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে। টুইটার থেকে ফেসবুক, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সর্বত্র একটা কথা বারবার লেখা হয়েছে— ইমরান দেশকে কী নিয়ন্ত্রণ করবে যখন সে একজন মহিলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথা ধরা যাক। তাঁর বক্তব্য হল, জীবনের এমন জঘন্য এক পর্ব থেকে নতুন করে ফিরে আসা ইমরানের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট এই বিশ্লেষকের মতে, ইমরান একটার পর একটা গর্হিত ভুল করে গিয়েছেন। গত বছর থেকে যখন তিনি খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছোচ্ছিলেন, তখন ভুল পরামর্শের পথে হেঁটে ধর্নায় বসেছেন। পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা নিতে গিয়েছেন। আর তার পর রেহামের সঙ্গে বিয়ে। যিনি ইমরানের উপযুক্তই ছিলেন না।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বলেন, জেমাইমার মতো শান্তস্বভাবের একজ নের পক্ষে ইমরানের সঙ্গে বিচ্ছেদ তিনি ভালই সামলে উঠেছেন। অনেকে তো এও বলেন, যে ইমরান-জেমাইমা বিচ্ছেদের জন্য ইমরানের বোনও অনেকাংশে দায়ী। তবে রেহাম-ইমরানের বিচ্ছেদের জন্য কিন্তু জেমাইমার দিকেও আঙুল কম ওঠেনি।
তা ছাড়া রেহামের যে খুব সুনাম ছিল, এমনও নয়। মিডিয়া সায়েন্সে যে ডিগ্রিটা আছে বলে তিনি দাবি করেছিলেন, তা ভুয়ো। যা নিয়ে তাঁকে অনেক গোলাগুলির মুখে পড়তে হয়েছে। তবে অনেকে বলেন, রেহামের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে এই সব নেগেটিভ খবরের পিছনে জেমাইমার বেশ ভাল রকম হাত ছিল।
আরও আছে। ইমরান যত অকেজো অস্ত্র নিজের পার্টিতে আমদানি করেছেন। তিনি যে শৈল্পিক স্টাইলে শুরু করেছিলেন, অর্থাৎ তরুণ, অপরিচিত মুখদের দিয়ে, সেটা করে গেলে প্রথম দিকে অসুবিধেয় পড়তে হত ঠিকই। কিন্তু পরে সাফল্য পেতে পারতেন। এই বিশ্লেষকের মনে হয়, ইমরানের ‘মোডাস অপারেন্ডি’ হওয়া উচিত ছিল ভারতের আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো।
শুধু তাই নয়, ইমরানের সতীর্থদের মধ্যেও কেউ কেউ বুঝে গিয়েছিলেন, রেহামের সঙ্গে ইমরানের বিয়ে টিকবে না। এক কিংবদন্তি প্রাক্তন ক্রিকেটার সেটা বললেনও। বললেন যে, রেহামের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার পরই নাকি তিনি বুঝেছিলেন যে, রেহামের উচ্চাশা মারাত্মক। ইমরানের সঙ্গে কিছুতেই বনবে না।
আসলে ইমরান বুঝতেও পারেননি যে এমন এক উচ্চাশাসম্পন্ন মহিলাকে বিয়ে করার ভুল সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের কতটা ক্ষতি করছে। ইমরান-রেহামের দেখা হয় গত জানুয়ারিতে। একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানে। ইমরান তখন পাকিস্তানের ‘মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলরদের’ একজন। রেহাম তখন পরিচিত বিবিসিতে আবহাওয়ার খবর পড়া আর পাকিস্তানি চ্যানেলে রাজনীতি নিয়ে শো করার জন্য।
ইমরানকে তখন জিজ্ঞেস করা হত যে, কেন তিনি জেমাইমা খানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আবার বিয়ে করলেন না? প্রথম দিকে ইমরান হাসতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ওঁর জনপ্রিয়তা যত বাড়তে লাগল, উনি নিজেই বুঝলেন যে এ বার জীবনে একজন সঙ্গী দরকার। নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার সময় হঠাৎই একদিন উনি বলে বসলেন যে, আবার বিয়ে করার কথা ভাবছেন!
গত অগস্টের ঘোষণাটাও চমকপ্রদ ছিল। ইমরান জনতার কাছে দরবার করে বসলেন, আমি চাই এই ধর্নাকে আপনারা সফল করুন। এই দুর্নীতিসম্পন্ন সরকারকে হঠানো দরকার, কারণ তার পরই আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি! শোনা যায়, রেহামের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই নাকি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন ইমরান।
ইমরানের একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন রেহাম। আর সেখানেই প্রেমের শুরু। রেহামকে বিয়ে করার জন্য পারিবারিক বিদ্রোহও পাত্তা দেননি ইমরান। তাঁর দুই বোন আলিম এবং রুবিনা ঘোরতর বিরোধী ছিলেন রেহাম নিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রেহামকে ইসলামাবাদে নিজের বিখ্যাত বন্নি গালা রেসিডেন্সে নিয়ে আসেন ইমরান। পরিবারকে দু’ভাগ করে।
প্রথম-প্রথম ভালই চলছিল সব। কিন্তু রেহামের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে খুব ভাল ভাবে নেননি ইমরানের কাছের লোকেরা। পার্টির কাজকর্মে রেহামের ক্রমাগত নাক গলানো ঝামেলা আরও বাড়িয়েছে। তার উপর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দু’টো উপ-নির্বাচনও হেরে যায়। যেখানে রেহামই ছিলেন তেহরিকের প্রচারের প্রধান মুখ। তাঁর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে বিরোধিতা বাড়তে দেখে রেহামও প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেন।
ইমরানের এক পারিবারিক বন্ধু বলছিলেন যে, বাড়িতে রাজনৈতিক বৈঠক বসার বিরোধী ছিলেন রেহাম। একবার তিনি এ নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করলে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক জাহাঙ্গির তারিন রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। এবং ইমরান-রেহামের বিচ্ছেদের পিছনে জাহাঙ্গিরও একটা কারণ। ঘটনা হল, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ এ সব স্বীকার করে না। কিন্তু না করলেই বা কী? সবই তো সত্যি।
রেহাম পরে বলেছিলেন যে, ইমরানের সঙ্গে তিনি একটা লম্বা পার্টনারশিপ চেয়েছিলেন। যেটা হল না। কিন্তু ম্যাঞ্চেস্টারে ক’দিন আগের আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলন কী ভাবে ভোলা সম্ভব? যেখানে রেহাম গনগনে ভাবে বলে দেন, ‘‘যে কেউ ছক্কা মারতে পারে। কিন্তু সে পার্টনারশিপে সেঞ্চুরি করাটাই আসল। ওটাই সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ।’’
ইমরান-রেহামের পথ এখন আলাদা। রেহাম ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর ইমরান? মনে হয় না কোনও দিন আর বিয়ের কথা ভাববেন। তবে জেমাইমার সঙ্গে ইমরানের কি পুনর্মিলন হতে পারে? আমি অন্তত সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেব না। বিচ্ছেদের পরও ইমরান কিন্তু লন্ডনে জেমাইমার ফ্ল্যাটেই থাকতেন। আর ভুলে যাবেন না, জেমাইমা কিন্তু ইমরানের দু’ছেলের মা। তবে আমার মনে হয় ইমরান এখন চান, নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার আবার ঠিকঠাক করে নিতে। ইমরান খানের এখন নিজের ভবিষ্যতের পুনর্গঠন দরকার। বড় পুনর্গঠন দরকার।
পুনশ্চ : এই লেখাটা তৈরির ফাঁকে সম্পূর্ণ অন্য কারণে দেশ থেকে ইমরানের ফোন এল। পাকিস্তানের সিরিজ কভার করার জন্য আমি দুবাইতে ছিলাম। দুবাই নম্বরেই ফোন। ক্যাপ্টেনের গলাটা দেখলাম খুব বিষণ্ণ। ইমরানের মতো সিংহহৃদয় মানুষকে এত অবসন্ন আগে কখনও শুনিনি। মনে হল, সত্যিই এখান থেকে ওঠাটা ওঁর কাছে বিশাল চ্যালেঞ্জ। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
৯ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আরিফুর রাজু/এআর