সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭, ০৭:১৮:১৩

ধারাভাষ্য ও ক্রিকেটের প্রথম ধারাভাষ্যকার দম্পতি

ধারাভাষ্য ও ক্রিকেটের প্রথম ধারাভাষ্যকার দম্পতি

স্পোর্টস ডেস্ক: ‘ধারাভাষ্য’ শব্দটির সাথে খেলা পাগল প্রায় সব মানুষেরই জানাশোনা আছে। রেসলিং এর মঞ্চ থেকে শুরু করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ফুটবল ও ক্রিকেট তো বটেই ম্যাড়মেড়ে গলফ কিংবা প্রচারযোগ্য বিলিয়ার্ডেও স্থান করে নিয়েছে ধারাভাষ্য। বস্তুত খেলা চলাকালীন সময়ে প্রচার মাধ্যমে খেলার সার্বিক অবস্থা দর্শকদের জন্য পর্যালোচনা করাকেই ধারাভাষ্য বলে থাকে। খেলায় ধারাভাষ্য যুক্ত হবার পর খেলা মানুষের কাছে যেমন আরও বেশি বোধগম্য হয়েছে তেমন খেলার যে আসল উদ্দেশ্য ‘নিখাদ বিনোদন আহরণ করা’ সে উদ্দেশ্য সাধনে এক ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

১৯১২ সাল থেকে খেলাধুলা যখন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার পাওয়া শুরু করে তখন শুরুর দিকটায় এর নিখাদ বিনোদনের মাত্রায় কিছুটা অপূর্ণতা ছিল। খেলাকে আরও সুন্দর ও সহজভাবে দর্শকদের মাঝে বোধগম্য করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯২১ সালে রেসলার জন রে ও জনি’র মধ্যকার রেসলিং ম্যাচ দিয়ে প্রথম কোনো ম্যাচে ধারাভাষ্যের সূচনা হয়, একই সাথে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের। ক্রিকেটে ধারাভাষ্য শব্দটি যুক্ত হয় তার ঠিক পরের বছর মানে ১৯২২ সালে।

ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান চার্লস ব্যানারম্যান এর সম্মানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নিউ সাউথওয়েলস তাদের ক্রিকেটারদের দুটি দলে ভাগ করে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে। আর সেখানে ধারাভাষ্যকার হিসাবে ধারাভাষ্য দিয়ে লেন ওয়াট ক্রিকেটে এর সূচনা করেন। তখন অবশ্য এখনকার সময়ের মত বল বাই বল ধারাভাষ্য দেয়া হতো না। ম্যাচের সারমর্ম বলে দেওয়া হতো মাঝের ইনিংস বিরতিতে একবার এবং খেলা শেষে একবার।

এভাবে চলেছিল আরও দু বছর। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচে প্রথমবারের মত বর্তমান সময়ের বলে-বলে ধারাভাষ্য দেওয়া শুরু হয়েছিল। এখানেও  ধারাভাষ্যকার হিসাবে ছিলেন ওই লেন ওয়াট। এর এক যুগ পর ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার নারী দলের টেস্ট ম্যাচে ধারাভাষ্যকার হিসাবে প্রথম কোনো নারী কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল রেডিওতে। ক্রিকেটের সেই প্রথম নারী ধারাভাষ্যকার ছিলেন মার্জোরি পোলার্ড।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মার্জোরি পেশায় একজন হকি খেলোয়াড় ছিলেন কিন্তু সে সময় নারীদের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। ১৯৩৭ থেকে ২০১৭ গুনে গুনে ৮০ বছর। এই ৮০ বছরে ক্রিকেটের আধুনিকায়ন হয়েছে, আধুনিকায়ন হয়েছে ক্রিকেট ধারাভাষ্যেও। নিজস্ব বাচনভঙ্গি, মেধা ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দিয়ে সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রীড়া সাংবাদিকরা ক্রিকেট ধারাভাষ্যকে করেছেন সমৃদ্ধ, নিজেরা হয়েছে এই ক্ষেত্রে একেকজন কিংবদন্তী।

৮০ বছরে ক্রিকেট ধারাভাষ্যে নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ থাকলেও ছিল না কোনো ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার দম্পতি। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ২ টেস্ট সিরিজের ১ম ম্যাচটি যখন মিরপুরের শেরে বাংলায় শুরু হলো, বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশন ‘রেডিও ভূমি ৯২.৮ এফএম’ থেকে একটি নারী কণ্ঠে সরাসরি সে ম্যাচের ধারাবিবরণী প্রচার করা হচ্ছিল। জান্নাত হুসাইন নামের এ নারী ধারাভাষ্যকার এই ম্যাচ দিয়ে যখন ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসাবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করলেন ততক্ষণে সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি ও জান্নাত হুসাইন দম্পতি বনে গেছে ক্রিকেট বিশ্বের প্রথম ধারাভাষ্যকার দম্পতি!

এর আগে বাবা ছেলের ধারাভাষ্য ক্রিকেট বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলেও স্বামী-স্ত্রীর একত্রে একই ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়ার ঘটনা ক্রিকেটে ছিল সেটিই প্রথম। স্বামী সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসাবে পিপলস রেডিওতে যাত্রা শুরু করেন ২০১৩ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) দিয়ে। তিনি ২০১৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক ম্যাচে ধারাভাষ্য প্রদানের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

গতানুগতিক ধারাভাষ্যের বাইরে এসে বাংলা ধারাভাষ্যকে আধুনিক ও দর্শক উপভোগ্য এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তারই চেষ্টায় মরতে বসা বাংলা ধারাভাষ্য এক নতুন প্রাণ পায়। জনাব সামি এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক, বিপিএল, আইপিএল, পিএসএল মিলিয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশি ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়েছেন। অন্যদিকে স্ত্রী জান্নাত হুসাইন ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সব সময় চেয়েছেন নিজেকে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কোনো পেশায় নিয়োজিত রাখতে। স্বামী সামি একজন ধারাভাষ্যকার হওয়ায় এই ক্ষেত্রটিতে আলাদা আগ্রহ কাজ করেছে তার।

অন্যদিকে  সামি সহযোগিতা করেছেন জান্নাতকে। ধারাভাষ্যের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন একেবারে নিবিড়ভাবে। এরই সুবাদে এখন জান্নাতও একজন ধারাভাষ্যকার, আর সামি-জান্নাত দম্পতি ক্রিকেটের প্রথম ধারাভাষ্যকার দম্পতি। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব ম্যাচ ও এবারের বিপিএলের সব ম্যাচেই ধারাভাষ্যকার হিসাবে রেডিও ভূমিতে ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ক্রিকেট বিশ্বে ক্রিকেটারদের বাইরে আমাদের গর্ব করার মত যায়গা রয়েছে সামান্যই। ক্রিকেটের একমাত্র ধারাভাষ্যকার দম্পতি বাংলাদেশি এমন ব্যাপারটি আসলেই গর্ব করার মতই।

অন্যদিকে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে নারীদের ক্ষমতায়ন ও নারী নির্যাতন নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো সারা বিশ্বের কাছে প্রতিনিয়ত খারাপ খরব প্রচারিত হয় তখন সামি-জান্নাত দম্পতি হতে পারেন তার বিরুদ্ধে অন্যতম এক উদাহরণ। হতে পারেন স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যকার পারস্পারিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অনন্য নজিরও।-আমাদের সময়
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে