শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪৩:১৯

ওদের বাড়িতে সোনা, রুপা আর ব্রোঞ্জ পদকে ছড়াছড়ি

ওদের বাড়িতে সোনা, রুপা আর ব্রোঞ্জ পদকে ছড়াছড়ি

আনোয়ার হোসেন: ওরা পাচঁজন একই পরিবারের সদস্য। বাবলু জামান, স্ত্রী মাহবুবা বেগম, তিন মেয়ে—মরিয়ম খাতুন (বিপাশা), মাউনজেরা (বর্ণা) ও উম্মে সালমা (ববি)। সবাই জাতীয় কারাতে ব্ল্যাক বেল্টধারী। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শান্তিপাড়ায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারাতে ও জুডো প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া সোনা, রুপা আর ব্রোঞ্জ পদকের যেন ওদের বাড়ি ভরে গিয়ে। এ পরিবারের প্রধান বাবলু জামানের ভান্ডারেও রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে অনেক স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক। বাবলু জামান বলেন, তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে, তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের তিন মেয়েসহ ৩৬ জন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসারে চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতেই আছেন ২৭ জন। সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরির পাশাপাশি এই মেয়েরা লেখাপড়ারও সুযোগ পাচ্ছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর হয়ে অংশ নেন তাঁরা। তিনি বলেন, এ সুযোগে এসব দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা গোটা পরিবারের অবলম্বন হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনে এটাই বড় আনন্দের বিষয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জজ আদালতে এমএলএসএস বাবলু জামান। সেই আয় দিয়েই তাঁর সংসার চলে। বয়স এখন ৫১। এসএসসি পাস বাবলু জামানের কারাতে শিক্ষার শুরু ১৯৮৪ সালে। একা একা, বই দেখে দেখে। কয়েক বছর এভাবেই চলছিল। এরপর তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পে আসেন জনি নামে এক প্রশিক্ষক। তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৯৯২ সালে রাজশাহীর নিউ ডিগ্রি সরকারি কলেজে অবস্থিত কারাতে দো একাডেমিতে তানভির কবির সিদ্দিক ও তাঁর ওস্তাদ হুমায়ুন কবীরের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জুডো কারাতে ও বক্সিং একাডেমি। প্রথম দিকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা আসত না। এ জন্য তিনি স্ত্রী মাহবুবা খাতুনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে একাডেমিতে নিযুক্ত করেন। সময় বদলেছে, মেয়েরা এখন তাঁর কাছেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে এই পর্যন্ত ২ হাজার ২৫০ জন ছেলেমেয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। একাডেমির শাখা খোলা হয়েছে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর এবং রাজশাহীর কাটাখালীতে। এখন প্রায় ২০০ জন ছেলে ও মেয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখানে ভর্তি ফি, মাসিক বেতন দিতে হলেও দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেন বাবলু। প্রতিষ্ঠানের আয় তিনি প্রশিক্ষণার্থী ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেন। বাবলু জামানের জীবনে সম্প্রতি একটি বড় আনন্দের ঘটনা ঘটেছে। চতুর্থ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতা ২০১৫-তে তাঁর তিন মেয়েরই স্বর্ণপদক লাভ। মরিয়ম খাতুন আনসার বাহিনীর পক্ষে কারাতে প্রতিযোগিতায় ৫৫ কেজি ও মাউনজেরা সেনাবাহিনীর পক্ষে ৫০ কেজি এবং সালমা সেনাবাহিনীর পক্ষে জুডো প্রতিযোগিতায় ৪৪ কেজি ওজন ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। তিন মেয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেনও একই দিনে। এর চেয়েও বড় আনন্দের দিন ছিল এই ক্রীড়া পরিবারের কাছে, যেদিন ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় (এসএ গেমস) বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদকটি আসে বাবলুর বড় মেয়ে মরিয়মের হাত ধরে। জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় সে খবর। এসএ গেমসে কারাতে প্রতিযোগিতায় দুটি স্বর্ণসহ বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে মরিয়মের ঝুলিতে এসেছে ৪৫টি স্বর্ণপদক।মরিয়ম এ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভারতের নয়াদিল্লি, গুজরাট ও কলকাতায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি এখন বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্রী। বাবলু জামানের দ্বিতীয় মেয়ে মাউনজেরার ঝুলিতে রয়েছে ১৮টি স্বর্ণপদক। আছে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদকও। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতা, ২০১৩ সালে জাপান কাপ কারাতে প্রতিযোগিতা, ২০১১ সালে প্রথম ফজিলাতুন্নেছা আন্ত এশিয়া প্রতিযোগিতা, ২০১২ সালে একই প্রতিযোগিতায় একাধিক স্বর্ণ-রৌপ্য পদকসহ শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হন তিনি। এ বছর চতুর্থ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতাসহ জাতীয় পর্যায়ের একাধিক প্রতিযোগিতায় তিনি স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত অষ্টম কমনওয়েলথ কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে ৪৮ কেজি ওজন ক্যাটাগরিতে রৌপ্যপদক পান তিনি। মাউনজেরা নেপাল ও ভারতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। মাউনজেরা এইচএসসিতে পড়ছেন। বাবলু জামানের তৃতীয় মেয়ে উম্মে সালমা ২০১১ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ক্যাডেট জুডো চ্যাম্পিয়নশিপ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) অনুষ্ঠিত একই প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মোট আটটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। উম্মে সালমা থাইল্যান্ড ও নেপালে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সালমা পড়ছেন দশম শ্রেণিতে। মরিয়ম বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে ২০১০ সালের এসএ গেমসে প্রথম সোনা জেতার মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়েছিল আমার। সবার আগে বাবার কথা মনে পড়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘সুখী এক ক্রীড়া পরিবারের সদস্য আমি। এ নিয়ে গর্ব হয়। ক্রীড়াকে ঘিরে অনেক আনন্দ আমাদের পরিবারে।’ মা-বাবা ও নিজেদের কৃতিত্ব নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন মাউনজেরা ও উম্মে সালমা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জিমনেসিয়ামে কারাতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বাবলু জামান ষ ছবি: প্রথম আলোস্বামী ও তিন মেয়েকে ঘিরে সুখানুভূতির কথা জানালেন মাহবুবা বেগমও। তিনি বলেন, ‘জীবনে যত আনন্দ ও সুখ পেয়েছি খেলাধুলাকে ঘিরেই। আমাকে ক্রীড়াবিদ বানানোর জন্য বাবলুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তবে খেলার প্রতি আমার ভালোবাসা ও প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠেছি।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের সঙ্গে আমাকে যেতে হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিজয় দেখার আনন্দই আলাদা।’ বাবলু জামানের প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীর ঝুলিতেও রয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক। বাবলু জামানের শিষ্যদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাঠানপাড়ার সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. শহীদ হোসেনের দুই মেয়ে শারমিন আক্তার (২১) ও আশরাফি আক্তার (১৯) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জুডো প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করেন। এ দুই বোনও এখন সেনাবাহিনীর হয়ে খেলছেন। শহীদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে মোট ২৩টি স্বর্ণপদক পেয়েছে। বড় মেয়ে শারমিন আক্তারকে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে মেয়েদের জুডো প্রশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তামুক্ত। খেলাধুলার পাশাপাশি তারা লেখাপড়াও করছে। বেতন-ভাতা থেকে পরিবারকেও সহায়তা করছে। পরিবারের জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারত না। এসব কিছুই হয়েছে বাবলু জামানের কল্যাণে।’ বাবলু জামানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন সেনাবাহিনীতে সুযোগ পাওয়া সুমি রানী হালদারের বাবা স্বপন হালদার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলবস্তির শাকিলা খাতুনের মা অলোকা বেগম, শান্তিপাড়ার সূচনা আলিফের পিতা সেলিম রেজাও। সেলিম রেজা বলেন, ‘আমার মেয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারাতে প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত পাঁচটি স্বর্ণপদক পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সে সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেয়েছে।’ বাবলু জামানের ক্রীড়া পরিবার। বাবা বাবলু জামান ও মা মাহবুবা বেগমের সঙ্গে তিন মেয়ে মরিয়ম বিপাশা (বাঁয়ে), উম্মে সালমা (মা-বাবার মাঝে) ও মাউনজেরা বর্ণা ষ ছবি: প্রথম আলোবাবলু জামান বলেন, ‘স্ত্রী, তিন মেয়ে নিয়ে আমাদের ক্রীড়া পরিবার। ছোট্ট একটি চাকরি করলেও ক্রীড়াকে অবলম্বন করে জীবনে অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি। ক্রীড়াকে ঘিরে আমাদের পরিবারে আনন্দের স্মৃতি অনেক। সেনাবাহিনীতে ২৭, আনসারে ৮ ও পুলিশে ১ জন—সব মিলিয়ে ৩৬ জন সুযোগ পাওয়ায় তাঁদের পরিবারেও আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। এটা অনেক বড় পাওয়া।’ তিনি বলেন, ‘আমার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে আমার কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে খেলোয়াড় হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যোগ্য করে তোলা।’ বাবলু জামান বলেন, ‘আমার আরও একটি বড় তৃপ্তির ব্যাপার হচ্ছে, আমার অতীত ও বর্তমানের কোনো শিষ্যই মাদক গ্রহণ করে না। তারা সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, জেলাতে এত স্বর্ণপদক এসেছে বাবলু জামানের হাত ধরে। জেলার জন্য এত সম্মান আর কেউ বয়ে আনতে পারেননি। বাবলু জামানের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তাঁর ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীতে সুযোগ পাওয়া। এতে দরিদ্র পরিবারগুলোর অনেক উপকার হয়েছে।জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি শফিকুল আলম ওরফে ভোতা বলেন, অসাধারণ এক ক্রীড়া পরিবার বাবলু জামানের। সারা দেশে এমন পরিবার হয়তো খুব কমই আছে। জেলার অন্যতম ক্রীড়াব্যক্তিত্ব তিনি।-প্রথম আলো ১৯ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/আল-আমিন/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে