সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:১৮:১৫

ডালমিয়ার ১৯৯৭ সালের অবদান কোন দিন ভুলবে না বাংলাদেশ

ডালমিয়ার ১৯৯৭ সালের অবদান কোন দিন ভুলবে না বাংলাদেশ

নাইর ইকবাল: জগমোহন ডালমিয়াবাংলাদেশকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন উপমহাদেশের চতুর্থ ক্রিকেট-শক্তি হয়ে ওঠার সব উপাদানই বাংলাদেশের আছে।

১৯৯৭ সালে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন ডালমিয়া। ক্রিকেটকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। তাঁর সেই মন্ত্রের জোরেই ক্রিকেট দুনিয়ায় নিজেদের অবস্থান করে নিল বাংলাদেশ। ২০০০ সালে আইসিসির সভাপতি পদে থাকা অবস্থায় তাঁরই প্রচ্ছন্ন মদদে বাংলাদেশ অধিষ্ঠিত হলো একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদায়।

ক্রিকেট শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে তাঁর মদদই কেবল ছিল না, ছিল এক ধরনের প্রশ্রয়ও। টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের মাঠের পারফরম্যান্স ছিল তথৈবচ। ব্যাপারটা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। ক্রিকেট উন্নাসিকেরা অনেকেই বলতেন, আইসিসিতে কেবল প্রভাব-বলয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই, টেস্ট খেলুড়ে জাতি হিসেবে প্রস্তুতিহীন বাংলাদেশকে টেস্ট খেলার অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডালমিয়া সেই অভিযোগ খণ্ডন করেছিলেন বাংলাদেশের মাথায় প্রশ্রয়ের হাত রেখে। বলেছিলেন, এই উপমহাদেশ থেকে তিনটি দেশ বিশ্বকাপ জিতেছে। চতুর্থ দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশও। দেশটিকে একটু সময় দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট তাঁর অঘোষিত অভিভাবককে বেঁচে থাকতে বিশ্বকাপ উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রিয় ‘দাদা’ দেখে গেছেন তাঁর সমর্থনপুষ্ট দেশটি এখন বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা শক্তিদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে জানে। বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে পরপর পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে বধ করা বাংলাদেশকে ‘মদদ’ দেওয়া যে তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না, প্রয়াণের আগে সেটা অন্তত জেনে যেতে পেরেছেন তিনি।

১৯৯৮ সালের কথা কীভাবে ভুলে যাবে বাংলাদেশ? ডালমিয়া তখন আইসিসির সভাপতি। লর্ডসে (তখন আইসিসির সদর দপ্তর ছিল ওখানেই) সভাপতির চেয়ারে বসেই মাথায় হাত তাঁর। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে নিজেদের দাবি করে আইসিসি, অথচ কোষাগার প্রায় শূন্য! সব জায়গায় স্থবিরতা, নতুন কোনো ভাবনা নেই। পৃষ্ঠপোষকেরা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। মোদ্দাকথা, খেলাটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। ঠিক এই সময়টাতেই ঝানু সংগঠক ও প্রশাসক ডালমিয়া বেছে নিলেন বাংলাদেশকে!
ডালমিয়া জানতেন ক্রিকেট বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয়। তিনি জানতেন দেশটিতে ঘরোয়া ক্রিকেটেও স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ থাকে (আশি-নব্বইয়ের দশকের কথা) দর্শকে। তাঁর ঠিক দশ বছর আগে, অর্থাৎ, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের মাটিতেই সফলভাবে আয়োজিত হয়েছিল এশিয়া কাপ ক্রিকেটের তৃতীয় আসরটি। পাঁড় ব্যবসায়ী ডালমিয়া বুঝে ফেলেছিলেন জনবহুল বাংলাদেশে আছে ক্রিকেটের দারুণ একটা বাজার। সেই ভাবনা থেকেই আইসিসির কোষাগার ভরাতে তিনি বাংলাদেশে আয়োজন করলেন ‘মিনি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে’র আসর। ১৯৯৮’ র অক্টোবরে নক আউট পদ্ধতিতে আয়োজিত সেই জমজমাট প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নিয়েছিল সে সময়কার সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দল (নয়টি)। উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ নামে পরিচিত সেই প্রতিযোগিতাই পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হিসেবে আইসিসির কোষাগার করেছে সমৃদ্ধ।

মিনি বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে আয়োজন করতে দিয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও সমাধা করলেন এই ক্রিকেট প্রশাসক। ক্রিকেট দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরেও এত বড় একটি প্রতিযোগিতা সাফল্যের সঙ্গে হতে পারে। সারা দুনিয়ার কাছে পরিচিত করে তুললেন বাংলাদেশের ক্রিকেট-সক্ষমতাকে, অন্তত প্রশাসনিক দিক দিয়ে। এই ব্যাপারটি যে বাংলাদেশকে মাত্র দেড় বছরের মাথায় (২০০০ সালের জুন) টেস্টের দশম সদস্য হতে সাহায্য করেনি, এমন ভাবনাটা বোধ হয় ভুলই।
২০০০ সালে আইসিসির সভাপতি হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন ডালমিয়া। নেপথ্য কারণ ছিল সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ। ২০০১ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ২০০৫ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে সেই পদও ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি, প্রায় আট বছর পর আবারও ভারতীয় ক্রিকেটের দৃশ্যপটে তিনি। ২০১৩ সালে ভারতীয় বোর্ডের সভাপতি পদে আবারও ফেরেন তিনি। তাঁর দেশ ভারত যখন ক্রিকেটের দুই পুরোনো অশ্বশক্তি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় ‘তিন মোড়ল তত্ত্বের’ প্রয়োগ ঘটাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ডালমিয়ার ভারতীয় বোর্ডের সভাপতি হওয়াটা ছিল অন্ধকারে এক বিন্দু আলোকরেখার মতোই।

নতুন করে ভারতের ক্রিকেট প্রধান হয়েও তিনি ভোলেননি বাংলাদেশকে। এ বছরের মার্চে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন শ্রীনিবাসনের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ, বিভিন্ন বিতর্কে দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, ঠিক তখনই তিনি বাড়িয়ে দেন তাঁর বন্ধুত্বের হাত। বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসকেরাও পরম নিশ্চিন্ত ছিলেন ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট সম্পর্ক নিয়ে। ওখানে আর যেই থাকুন ‘দাদা’ তো আছেন।

হঠাৎ মৃত্যু তাঁকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বাংলাদেশের কাছ থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর অবদান তাঁকে অমরত্বই দিচ্ছে এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।-প্রথম আলো
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে