দেবাশিস দত্ত : প্রবল হাস্যরোল। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে, রাজধানী ক্যানবেরায় প্রভূত আনন্দ বিতরণ করার যে দায়িত্ব নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া, তাতে তারা সফল। লোক হাসানোর যে পালায় পার্থ, ব্রিসবেন, মেলবোর্নে যারা দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন, তারা ক্যানবেরাতেও একেবারেই হতাশ করেননি।
বুধবার চার বল বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়া জিতে গেল ২৫ রানে। ব্যবধান ৪–০। সিডনিতে ৫–০ হওয়ার যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি এদিনই দিয়ে রাখলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং তার দল।
খেলা চলার মাঝে একটি চমৎকার বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, টি ২০ বিশ্বকাপের হাওয়া গরম করার জন্য। যেখানে ধোনির চুল কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করছেন নায়ক, মহিলা নাপিতের সঙ্গে।
ধোনি বলছেন, ‘পাত্থর মারেঙ্গে রোড পে লোক।’ চুলের ছাঁট যদি ওই মহিলার কথা অনুযায়ী তিনি করে ফেলেন, তা হলে, রাস্তায় ঢিল ছুঁড়তে শুরু করবে জনতা। ০–৪ ব্যবধানে নয়, সত্যিই যদি সিডনিতে হারতে হয়, তা হলেও মুম্বাই বা দিল্লি বিমানবন্দরে, যেখানেই অবতরণ করুক না কেন দল, কেউ তার দিকে ঢিল ছুঁড়বেন না। ক্রিকেটপ্রেমীরা গত ২–৩ বছরে ভারতের এমন হারের সঙ্গে এতটাই নিজেদের ধাতস্থ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিন যেভাবে ভারতকে হারতে হল, তা শুধু ভারতের এই দলের পক্ষেই সম্ভব। ১ উইকেটে ২৭৭ ছিল স্কোর, ৩৭.২ ওভারের সময়। তখন বাকি ছিল মাত্র ৭২ রান। হাতে ৮ উইকেট। এবং ছিল ৭২ বল। ৩৪৮ রান তাড়া করতে গিয়ে যখন অস্ট্রেলীয় বোলারদের নাকে খত দেওয়ার মতো অবস্থা করে দিয়েছেন শেখর ধাওয়ান–বিরাট কোহলি জুটি।
কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব ছিল না, ভারত এ ম্যাচে জিততে পারবে না। অর্থাৎ ভারত হারিয়েছিল পরবর্তী ৯টি উইকেট ৪৬ রান যোগ করতে গিয়ে। ডুবে মরার মতো পরিস্থিতি। শুধু একবার নয়, বারবার ঘটছে এমন। দামি কোচ, নামী অধিনায়কের হাতে পড়ে দলটা অনেকটা সাম্বিয়াদের মতো বখাটেদের আখড়া হয়ে যাচ্ছে।
অতিরিক্ত পয়সাকড়ি হয়ে গেলে যে ঔদ্ধত্য বাসা বাঁধে মস্তিষ্কে, এটাও তেমন একটি ঘটনা। রাজধানীর গতিতে এগোচ্ছেন ওরা, বেপরোয়া মনোভাবের চাদরে নিজেদের শরীরকে ঢেকে। কেউ কি ওঁদের একটা হ্যাঁচকা টান দেবেন? হারাটা বড় কথা নয়। হারের ভঙ্গিটা খুব খারাপ। প্রত্যাবর্তনের জন্য সেই মারকাটারি মনোভাবটাই দেখা যাচ্ছে না। নিজেদের দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়া টানা ১৯টি ম্যাচ জিতল। রেকর্ড।
বুধবারও খেলার ধরনে ছিল একই গতি। তফাত এই যে, টানা ৩ ম্যাচের পর অস্ট্রেলিয়া এদিন শুরুতে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে নিতে চাইল, অপ্রয়োজনীয়। যেন গোটা দুনিয়াকে স্টিভ স্মিথ দেখাতে চাইলেন, আগে ব্যাট অথবা পরে ব্যাট, ম্যাচের ফলাফলে কোনও হেরফের হবে না। কিন্তু, হয়ে যাচ্ছিল। রোহিত শর্মা (৪১) আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় উইকেটে শেখর ধাওয়ান এবং বিরাট কোহলি ২১২ রান যোগ করে খেলার মোড় যেভাবে ঘুরিয়েছিলেন, তা দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তাদের দল শেষ পর্যন্ত হেরে যাবে।
শেষ ১০ ওভারে অস্ট্রেলিয়া তুলেছিল ১১১ রান। আর সেখানে ভারতের সংগ্রহ মাত্র ৩৭, হারাতে হয়েছে ৬টি উইকেট। শেষ ১০ ওভারের বোলিং এবং ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা শোধরাতে পারা যাচ্ছে না। অথচ কোচিং, টিম মিটিং, হাডলে মাথা নিচু করে ভাষণ দেওয়ার এবং শোনার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। চাপের মুখে ভেঙে পড়ার যে অজস্র উদাহরণ ভারতের ক্রিকেটাররা অতীতে রেখে গেছেন, এটি ওই তালিকায় নবতম সংযোজন।
অথচ দেখুন, বিরাট কোহলি ২৫ নম্বর সেঞ্চুরিটা তুলে নিলেন মাত্র ৯২ বলে। শেখর ধাওয়ান পেলেন নবম শতরান। লেগেছে ১১৩ বল। রান। দ্রুতগতিতে রান, ৩৪৮ রান যে দল তাড়া করতে চায়, তাঁদের তো দ্রুতগতিতে রান তোলার দিকে নজর দিতেই হবে। ধাওয়ান–কোহলি জুটির খেলায় সেই চেষ্টাটাই ছিল। ৪ নম্বরে তুলে নিয়ে এসেছিলেন ধোনি নিজেকে।
ক্রিজে ছিলেন ৩ বল। রান করেছেন ০। বাকিরা ছিলেন আয়ারাম এবং গয়ারামের ভূমিকায়। মিডল অর্ডার ভোঁতা, লোয়ার অর্ডার ঠিক কতটা খাজা, এটা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই। ৪৭তম ওভার বল করতে এসেছিলেন ডেথ ওভারের ওস্তাদ বোলার জেমস ফকনার। ব্যাট করছিলেন উমেশ যাদব। একটা খুচরো রান নিয়ে উল্টোদিকে দাঁড়ানো রবীন্দ্র জাদেজাকে তিনি স্ট্রাইক তো দিতেই পারলেন না, উল্টে শেষ বলে এক রান নিয়ে পরের ওভারেও ব্যাট করে গেলেন। ক্রিকেটীয় বুদ্ধির অভাব।
ভারত কিন্তু একই জায়গায় আটকে থাকল। টানা ৪ ম্যাচে ৩০০ রান তোলাটা একটা ব্যাপার বটে। ভাল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হবে, ভারতের চেয়েও ওঁরা একটু বেশি ভাল। ফিল্ডিংয়ে স্টিভ স্মিথরা কয়েক মাইল এগিয়ে আছেন। ধোনির টিমের বোলিং সম্পর্কে নতুন বিশেষণ খুঁজে পাচ্ছি না। স্টক শেষ। গজা বোলিং, শব্দটা কি ব্যবহার করা যায়?
মানসিকতার প্রশ্নেও অস্ট্রেলিয়া হাফ টাইমের আগে ৬ গোল দিচ্ছে ভারতকে। একটা নমুনা দিই। ৪৭তম ওভার বল করতে এসেছিলেন মিচেল মার্শ। হঠাৎ পায়ে টান, বল করতে পারবেন? দুশ্চিন্তা। ফিজিও এলেন মাঠে। একটু জল খেয়ে, সামান্য হাত–পা ছুঁড়ে অস্বস্তি নিয়েই বল করলেন পরের ২টি ওভার। এবং পেয়েও গেলেন ২ উইকেট। জয়, একটা জয়ের জন্য অজিরা নিজেদের জীবন দিতেও প্রস্তুত। এভাবেই ছোট থেকে ওঁরা নিজেদের তৈরি করেছেন।
কেন রিচার্ডসন তুলে নিলেন ৫ উইকেট। ভারতীয় শিবির থেকে ওকে উপহার দেওয়া হয়েছে অন্তত ৩ উইকেট। তাতে কী? এ কথা বললে তো আঙুর ফল টকের গল্পের মতো শোনাবে। ব্যাটসম্যানদের স্বর্গে যিনি ৫ উইকেট পান, তারই তো ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পাওয়া উচিত। পেলেনও তাই।
পুনশ্চ: সঞ্জয় মঞ্জরেকার কয়েক দিন আগে লিখেছিলেন, সেঞ্চুরি পাচ্ছে ভারতীয়রা, আর ম্যাচ জিতছে অস্ট্রেলিয়া। এদিনও অ্যারন ফিঞ্চের ১০৭ বলে ১০৭ রানের ইনিংসটার জবাবে শেখর ও বিরাট সেঞ্চুরি করল। কিন্তু, ম্যাচ জেতা গেল না।
লেখক : ভারতীয় ক্রীড়া সাংবাদিক
২১ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি