শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ০৫:০০:৫৫

খাওয়ার জন্য ভিক্ষা করতেন, আজ তিনি বিশ্ব ফুটবলের তারকা

খাওয়ার জন্য ভিক্ষা করতেন, আজ তিনি বিশ্ব ফুটবলের তারকা

স্পোর্টস ডেস্ক: দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের মিথস্ক্রিয়ার গল্পটা একেবারে নতুন কিছু নয়। পেলে-গারিঞ্চা থেকে রোমারিও-রিভালদোরা এ গল্পেরই চরিত্র। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই ফুটবল মঞ্চে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা উড়িয়েছেন তারা।

আধুনিক এ যুগে এসেও এই গল্পের পরম্পরা শেষ হয়নি। বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে এখনো ফুটবল দুনিয়ায় আলো ছড়াচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান তারকারা। গল্পটা ভিন্ন নয় রাফিনিয়ারও। হ্যাঁ, সেই রাফিনিয়া, যাঁকে নিয়ে কদিন আগে দলবদলে চেলসি ও বার্সেলোনার লড়াই হলো। 

সেই লড়াইয়ে জিতে লিডস ইউনাইটেড থেকে রাফিনিয়াকে ক্যাম্প ন্যুতে নিয়ে যায় বার্সেলোনা। আর এই ব্রাজিলিয়ানই এখন বার্সেলোনার অন্যতম বড় ভরসা। ব্রাজিলের শহর পোর্তো আলেগ্রিতে ১৯৯৬ সালে জন্ম রাফিনিয়ার। পোর্তো আলেগ্রিকে চেনা মনে হচ্ছে? 

ঠিকই ধরেছেন, এটি সেই শহর, যেখানে জন্মেছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোনালদিনিয়ো, যিনি আবার রাফিনিয়ার শৈশবের নায়কও বটে। ব্রাজিলের অন্যতম জনবহুল শহরে শৈশব থেকেই রাফিনিয়াকে লড়তে হয়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর প্রলোভনের সঙ্গে।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চেয়ে বিপথগামী হওয়ার ফাঁদের সঙ্গেই লড়াইটা বেশি করতে হয়েছে তাকে। ইউওএল ই-স্পোর্তে নিজের গল্প বলতে গিয়ে শুরুতেই এই ব্রাজিলিয়ান লিখেছেন, ‘আমাকে সত্যিটা বলতে হবে, এটা বেশ জটিল।’ গল্পের শুরুতেই কেউ যখন সত্যিটা বলতে চান, সেই গল্প সরল কোনো গল্প হওয়ার কথা নয়। 

রাফিনিয়ার গল্পও হয়নি। আবার বেশির ভাগ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারকে বিবেচনায় নিলে তার গল্পটা খুব অপরিচিতও নয়। তবুও প্রত্যেকের গল্পটা তার নিজের, লড়াইটাও নিজের। রাফিনিয়ার সঙ্গে পথচলা শুরু করে কত নামই তো বিস্মৃত। কতজনই তো হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। 

রাফিনিয়ার মতো অল্প কজনই থাকেন, যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেন। সকালের সূর্যটাই নাকি সারা দিনের পূর্বাভাস দেয়। কখনো কখনো ব্যতিক্রমও হয়। রাফিনিয়ার নিজের গল্পের শুরুটাও ছিল মলিন।

শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে রাফিনিয়া লিখেছেন, ‘আমি যে পাড়ায় জন্ম নিয়েছি, সেখানে মনোযোগ ঠিক রাখাটা কঠিন। আমি এসেছি রেস্তিনগা (পোর্তো আলেগ্রির একটি অঞ্চল) থেকে, যেখানে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলা এবং বিপথগামী না হওয়াটা কঠিনই।’

হারিয়ে যাওয়ার পথটা সঙ্গীদের মতো রাফিনিয়ার জন্যও খোলা ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল অর্থ কিংবা মা’দকের ফাঁ’দ। তবু কেউ কেউ দৃশ্যমান এসব পথে না হেঁটে ভিন্ন কিছু করবেন বলেই জন্মান।

পথটা কেমন ছিল রাফিনিয়ার মুখেই শোনা যাক, ‘অনেক সুযোগ আসে। তারা আপনাকে অর্থ উপার্জনের সহজ পথের প্রতিশ্রুতি দেয়। আর এটিই ফাঁদ, যেখানে মানুষ হারিয়ে যায়। আমি কখনো সে পথে যাইনি। তবে আমি সাক্ষী হয়েছি, সেই মানুষদের পাশে হেঁটেছি, যারা হারিয়ে গেছে।’

সাধারণত অর্থের হাতছানি যে সহজ পথটির কথা বলে, তা কখনোই সহজ হয় না। তবে এ প্রলোভনে একবার পড়লে বেরিয়ে আসার পথটা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে। অনেক প্রতিভাবান মুখও আর বের হতে না পেরে হারিয়ে যান অকালেই।

সেই প্রতিভাবান বন্ধুদের নিয়ে রাফিনিয়ার আক্ষেপটা এ রকম, ‘অ পরা ধ ও মা দক ব্যবসায় আমি আমার অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। সেই বন্ধুদের হারিয়েছি, যারা আমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভালো খেলত। তারা চাইলেই বিশ্বের যেকোনো সেরা ক্লাবে খেলতে পারত।’

শুধু প্রতিভা দিয়ে অবশ্য গল্পের ধারা কিংবা পথের রেখাটা বদলানো যায় না। নিষ্ঠা ও পরিশ্রমও সেখানে থাকতে হয়। আর এখানেই রাফিনিয়া আলাদা। তিনি জানতেন, কী চান এবং কীভাবে তা অর্জন করতে চান। সামনে থাকা এই উদাহরণগুলোকেই ভিন্নভাবে কাজে লাগিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এই দৃষ্টান্তগুলো আমার মনোযোগ ধরে রাখার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। খুব ছোটবেলা থেকে আমি জানতাম, আমি কী চাই। একজন ফুটবলার হতে চাওয়ার এই লক্ষ্য অর্জনে নিজের এলাকা ছাড়া ছিল বড় ত্যাগ। তবে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল আরও বড়, যেখান থেকে আমি কখনো বিচ্যুত হইনি। আজ কেউ যদি ফুটবলে আমার জাদু নিয়ে কথা বলে, আমি বলব—এটাই আসল জাদু।’

এই জাদু অবশ্য অনায়াসে আসেনি। নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে প্রলোভন এড়ানোর সঙ্গে আরও নানা ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। বাসায় খাবারের অভাব না থাকলেও খাওয়ার জন্য করতে হয়েছে ভিক্ষাও। খেলার জন্য, অনুশীলনের জন্য প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হতো রাফিনিয়াকে। সেই সময় বাড়তি কোনো পয়সা থাকত না রাফিনিয়ার গাঁটে।

অনুশীলনের পর কী হতো, রাফিনিয়া সেই বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘এটা বলা অন্যায় হবে যে আমাকে ক্ষুধায় কষ্ট পেতে হয়েছে। কারণ, আমার মা-বাবা বাসায় কখনো খাবারের অভাব রাখেনি। এরপরও অনুশীলনের পর আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে বলতাম খাওয়ার জন্য কিছু কিনে দিতে।’

তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে, অন্যরা না করে দিত। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে বাসের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর তখন কিছুই করার ছিল না। এরপরই আমি কিছু খেতে পারতাম। এটা তখনকার কথা, যখন আমার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর।’

এটুকু পথ পাড়ি দেওয়ায় পরিবারের অবদানটাও ভোলেননি রাফিনিয়া। স্বপ্নের পথে যাত্রায় পরিবার কীভাবে তার পাশে ছিল, তা জানাতে গিয়ে রাফিনিয়া বলেছেন, ‘আমার পরিবারের কারণেই আমি স্কুল থেকে ঝরে পড়িনি এবং ভুল পথে পা দিইনি। তাদের কারণেই আমি আজ এখানে।’ সূত্র: প্রথম আলো

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে