স্পোর্টস ডেস্ক: ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না!
গত শতকে সেই আটের দশকে দিল্লি এশিয়াডের সময় বলেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সর্বজন শ্রদ্ধেয় পিকের মন্তব্য এত বছর পরেও একইরকম প্রাসঙ্গিক৷ এতটাই যে স্বচ্ছন্দে ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির মুখে বসিয়ে দেয়া যায়৷
চলতি অস্ট্রেলিয়া সফরে চারটে ম্যাচে হার, তার আগে দেশের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ধরলে টানা পাঁচটা হার৷ যথারীতি দেশ জুড়ে 'গেল, গেল' একটা আওয়াজ উঠছে৷ ধোনি হঠাও, টিম বাঁচাও৷ ফিনিশার ধোনি শেষ, ক্যাপ্টেন ধোনি শেষ, থিঙ্কার ধোনি শেষ! ভালো কথা৷ ধরা যাক, শেষ ওয়ান ডে-টার পরে ধোনিকে সরিয়ে বিরাটকে ক্যাপ্টেন করে দেয়া হলো৷ তিনটে টি-টোয়েন্টির জন্য৷ কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, ভারত জিতবে? একটা ম্যাচও?
পারা সম্ভব নয়, কারণ টিম ইন্ডিয়ার দোকানে মাল নেই৷ বিশ্বমানের স্ট্রাইক বোলার নেই, ডেথ-এ নিখুঁত ইয়র্কার ফেলার লোক নেই, ৪৫ ওভারের পরে নেমে ওভার প্রতি সাত বা আট তুলে ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ শেষ করার ফিনিশার নেই৷ ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা ছাড়া যেমন বিরিয়ানি রান্না করা যায় না, ঠিক তেমনই দোকানে মাল না থাকলে ম্যাচ জেতা যায় না৷ আই ফোন ফোর দিয়ে কি আই ফোন সিক্সের মানের ছবি পাবেন?
যে টিমের এক নম্বর বোলার ইশান্ত শর্মা এত বছর খেলার পরেও ৫০ নম্বর ওভারে বল করতে এসে ১৮ রান দেন, সে টিম কী করে জিতবে? যে টিমে মিডল অর্ডারে ধোনি কোন দিন রান না পেলে ছয় নম্বর থেকে ১০-১৫ রান করে দেয়ার মতো কোনও ব্যাট নেই, সে টিম কী করে জেতার আশা করে?
অলরাউন্ডার হিসেবে এই সফরে টিমের সঙ্গে ঋষি ধাওয়ান আর গুরকিরত্ সিং৷ ১১৫ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে বল করছেন ধাওয়ান, ওয়াসিম আক্রম ধারাভাষ্যে বললেন, 'স্লো মিডিয়াম৷' আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এখন এমন একটা সরণিতে, যেখানে এমন অলরাউন্ডার বাংলাদেশের অলিতে গলিতে উঁকি মারলেও পাওয়া যাবে৷ একই অবস্থা গুরকিরত্ সিংয়ের৷ অফস্পিনার হিসেবে রদ্দি মার্কা বললে কম বলা হয় আর ব্যাটসম্যান হিসেবে চাপ নেওয়ার দম যে এখনও নেই, সে তো ক্যানবেরার ম্যাচেই বোঝা গিয়েছে৷ চলবে না, চলার কথা নয়৷
চারটে ম্যাচ, তার মধ্যে তিনটেতে ৩০০ প্লাস রান, একটায় ২৯৫৷ মেলবোর্নের মাঠ মাথায় রাখলে অন্য মাঠে এটাও ৩০০ প্লাস৷ চারটে ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে পাঁচটা সেঞ্চুরি৷ দুটো রোহিত, দুটো বিরাট, একটা শিখর৷ রাহানেও একটা পেতে পারতেন৷ এর মধ্যে আবার একটা রোহিতের ১৭১ নট আউট আছে৷ তার পরেও টিম পরপর চারটে ম্যাচে হারলে সহজ ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা একটাই৷ পাতে দেওয়ার মতো বোলিং নেই৷
ইশান্ত শর্মা এত বছর পরেও ধারাবাহিকতার 'ধ' দেখান না, পেশিবহুল উমেশ যাদব ওভারে একটা ভালো ডেলিভারি করলে পরের চারটে অবধারিত লেগ স্টাম্পে করবেন৷ ভুবেনশ্বর কুমার পেস বাড়াতে গিয়ে সুইংটাই হারিয়ে ফেলেছেন৷ পেস হয়তো বেড়ে ১২০ থেকে ১২৫ হয়েছে, কিন্ত্ত উইকেট পাওয়ার ক্ষমতাটাই চলে গিয়েছে৷ নতুন ছেলে বরিন্দর স্রান একেবারে আনকোরা, বহু ঘষতে-মাজতে হবে৷
এই যদি হয় পেস অ্যাটাক, ক্যাপ্টেন কী করবেন? ফিল্ডিং সাজাচ্ছেন এক, বোলার বল করছে আর এক৷ যত বড় ক্যাপ্টেনই আসুন না কেন, হাত কামড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই৷ ভুল স্ট্র্যাটেজি যদি হয়ে থাকে, সেটা মেলবোর্নের ম্যাচে অশ্বিনকে বসানো৷ ওই একটা ম্যাচেই বল ঘুরছিল৷ জাডেজাকে খেলতে সমস্যা হচ্ছিল অজিদের৷ কিন্ত্ত একদিক থেকে ব্যাটসম্যানদের উপর যতটা চাপ দিচ্ছিলেন জাডেজা, উল্টোদিক থেকে তত আসছিল লুজ বল৷ গুরকিরতের জায়গায় অশ্বিন থাকলে ব্যাপারটা হত না৷ প্ল্যানিংয়ের অভাব৷
এই সিরিজটার পরে বিরাটকে ক্যাপ্টেন্সি দেওয়ার উপায়ও নেই, কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত ধোনিকে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করে দেওয়াই আছে৷ দেশে ফিরে পুরো টিমটাকেই চলে যেতে হবে টি-টোয়েন্টি মোডে৷ প্রথমে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তিনটে টি-টোয়েন্টি, প্রায় ঘাড়ে বাংলাদেশে এশিয়া কাপ৷ তার পরে বিশ্বকাপ৷ দেশে ফেরার পরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দুটো ম্যাচ জিতলেই আবার বুক বাজিয়ে শুরু হয়ে যাবে 'তাই রে নাই রে না!'
ঠিক যেমন হয়েছিল ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের সময়৷ টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে সিরিজে ভরাডুবির পরে টেস্টে খোঁয়াড় বানিয়ে ৩-০ জিতে সে কী নাচানাচি! অথচ গত দু'বছরে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সর্বত্র টেস্ট সিরিজ হেরে এসেছে৷ জয় বলতে শুধু ২০১৪ সালে লর্ডস টেস্ট৷ তার পরেও বিশ্বের এক নম্বর!
আর ওয়ান ডে? ২০১৫-এর মার্চে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের পরে টিম খেলেছে ১৫টা ওয়ান ডে৷ জয় ছ'টা, হার ন'টা৷ পরপর সিরিজ হার বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে৷ তা হলে আর বিরাট কোহলি ২৫টা সেঞ্চুরি করলেন কি না বা রোহিত আবার একটা ডাবল সেঞ্চুরি করলেন কি না, তাতে কী এসে যায়?
ব্যক্তির কীর্তি শুনতে বা দেখতে যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, টিম না জিতলে তা স্রেফ রেকর্ডই থেকে যায়৷ বিশ্বকাপ আসছে৷ ফর্ম্যাট আলাদা, অস্ট্রেলিয়ার বদলে খেলা দেশের মাঠে৷ পরিবেশ, পরিস্থিতি, সব অন্যরকম৷ হতেই পারে, ছবিটা রাতারাতি 'উল্টে দেখুন, পাল্টে গেছে' হয়ে যাবে৷
কিন্তু শত মলম লাগালেও অস্ট্রেলিয়া সফরের দগদগে ঘা সহজে মিলিয়ে যাওয়ার নয়৷ সূত্র : এই সময়
২৩ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ/আরিফুর রাজু/এআর