স্পোর্টস ডেস্ক : রিকেটার কেবল নয়; কোন জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই আসে শতবর্ষের আরাধনায়। মাশরাফি হলো গ্রিক ট্রাজেডি আর ভারতীয় রোমান্টিকতার মিশেলে এক মহাকাব্য। সে মাশরাফি বিন মুর্তজার জীবনী লিখেছেন সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। ‘মাশরাফি’ নামের বইটি এরই মধ্যে তৈরি করেছে বিপুল আলোচনা।
মাশরাফিকে নিয়ে প্রখ্যাত কোচ ডেভ হোয়াটমোরের লেখা আশীর্বাণী-
বয়স হয়েছে। ধোঁয়ায় ঢাকা একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
দিনটাও মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করছিলাম। কে একজন দেখিয়ে দিল কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে আসতে থাকা ছেলেটিকে। দীর্ঘদেহী, শক্ত গড়নের, লিকলিকে একটা ছেলে। কাছে আসতে শিশুদের মতো মুখটা নজর কাড়ল। কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি ইংরেজি বলছিলাম বলে মনে হয় একটু বেশি সংকুচিত ছিল।
একটু সময় নিয়ে ওর জড়তা ভাঙানোর জন্যই জানা নামটা আবার জিজ্ঞেস করলাম। মাথা নিচু করে একটু লাজুক হেসে বলল- মাশরাফি বিন মুর্তজা।
হ্যাঁ, আপনাদের জন্য মাশরাফি বিন মুর্তজা’ ম্যাশ। আমার কাছে পাগলা।
সম্ভবত কোনো একটা ইনজুরি কাটিয়ে ফেরার পর পাগলার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। এরপর এই সংক্ষিপ্ত পরিচয়টা কালক্রমে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। জীবনে কখনো কোনো খেলোয়াড়ের প্রতি পক্ষপাত দেখাইনি; পাগলার প্রতিও দেখাইনি। তবে এটুকু বলতে পারি, মানুষ হিসেবে আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর একজন হয়ে উঠেছে পাগলা; আজও তাই আছে।
দুনিয়ার সব বোলারই একটু পাগলা হয়। ফাস্ট বোলাররা হয়তো একটু বেশিই হয়। মাশরাফিকে কয়েকটা দিন দেখার পর মনে হলো, ও তাদেরই মতো বা তার থেকে একটু বেশি। বাংলাদেশে আসার পর থেকে ওর সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। জোরে মোটরসাইকেল চালায়, খুব দুষ্টুমি করে, প্রথম সংকোচ কেটে যাওয়ার পর মুখে আর লাগাম থাকে না। একসঙ্গে কাজ শুরু করার পর দেখলাম, সবই সত্যি। ওর দমকা হাওয়ার মতো চরিত্রটা দেখে একটা কথাই মনে হলো- ক্রেজি।
কে যেন আমাকে ‘ক্রেজি’ শব্দটার বাংলা বলল- পাগলা।
আমি তো এই শব্দের অর্থ জানতাম না। কিন্তু শব্দটা শুনেই মনে হলো, ম্যাশের সঙ্গে এর চেয়ে ভালো শব্দ আর যায় না। সেই থেকে ওকে আর কখনো আমি মাশরাফি বা ম্যাশ বলে ডাকিনি। আমার কাছে পাগলাই রয়ে গেছে মাশরাফি।
আজকের বাংলাদেশের অসাধারণ নেতা, বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন এখনো আমার কাছে পাগলাই বটে।
পাগলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে কী বলা যায়?
আমি জানি, লোকে এটাতে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। আমি কখনো তা বলি না। আমার কোনো ক্রিকেটারের কাছে কখনো ‘পিতা’ হয়ে উঠতি চাইনি। অবশ্যই আমি যত দিন বাংলাদেশে ছিলাম, পাগলার সঙ্গে আমার কোচ-ক্রিকেটারের চিরায়ত সম্পর্কই ছিল। হ্যাঁ, আমি তো বুড়ো মানুষ। বয়সের পার্থক্যটা অনেক ছিল; বেশির ভাগ ক্রিকেটারের সঙ্গেই অনেক বয়সের পার্থক্য ছিল আমার। সে জন্য হয়তো লোকেরা বুড়ো মানুষটাকে কিশোর পাগলার সঙ্গে মেলাতে গিয়ে এই সম্পর্কের ধরন ভেবে নিয়েছে!
সত্যি বলি, আর দশটা ক্রিকেটারের চেয়ে আলাদা করে কখনো ওকে ভাবিনি। হ্যাঁ, আমার পেস বোলিং দলের নেতা ছিল সে। তার মধ্যে সেই নেতৃত্বগুণটা ছিল। যে জন্য হয়তো তাকে কেন্দ্র করে আমাকে কিছু পরিকল্পনা করতে হতো। একটু বেশি কথা বলতে হতো। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
আমি কখনো পাগলার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে চাইনি। পাগলা চেয়েছে কি না, বলেছে কি না; সেটা আলাদা আলোচনা। তবে আমি যেটা করতাম, দীর্ঘ আড্ডায় জীবন বোধ, জীবনযাপন এগুলো নিয়ে আমার চিন্তাটা হয়তো বলতাম। সেটার প্রভাব তার ওপর কখনো পড়েছি কি না, সে এগুলোতে আদৌ একমত ছিল কি না; আমি জানতাম না।
তবে কখনোই যেচে তার মাঠের বাইরের জীবন নিয়ে মন্তব্য করতাম না। হ্যাঁ, তার প্রয়োজন হলে হয়তো আলোচনাটা উঠত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, মাঠের বাইরে ওর চমৎকার একটা উপভোগ্য জীবন ছিল। এই বয়সী ছেলেদের মতো উদ্যাম একটা জীবন ছিল। সেখানে আমার অংশগ্রহণ খুব জরুরি ছিল না।
হ্যাঁ, আমি ওর সঙ্গে অনেক মিশেছি, অনেক প্রলম্বিত আড্ডা দিয়েছি আমরা। ওর বাড়িতে গিয়ে মজা করেছি। ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাই একাকার হয়ে গেছি। সেগুলোর সবই ছিল আসলে আমাদের দলের যে পারস্পরিক অসাধারণ সম্পর্ক, তার বহিঃপ্রকাশ।
আমি জানি, আমি বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর বা থাকতেও আমাদের সম্পর্ক অনেক সময় আলোচ্য হয়ে উঠেছে। তবে আমি মাশরাফির প্রতি কখনো পক্ষপাত দেখিয়েছি, এমন কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। ওর তো পক্ষপাতের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
হ্যাঁ, ওর সঙ্গে একটু বেশি কথা বলতাম।
কারণটা বুঝতে হবে। মাশরাফি প্রায়ই ইনজুরিতে পড়েছে তখন। মানুষ হিসেবে আমার কী করা উচিত ছিল? আমাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে হতো; অনেক কথা বলতে হতো। চেষ্টা করতাম, ওর উৎসাহটা ধরে রাখতে। এমন হতে পারে, এই অতিরিক্ত সময় কাটানো, অতিরিক্ত গল্প করা হয়তো লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। তবে এটুকু জোর গলায় বলি, পাগলাকে আমি জীবনে কখনো একবিন্দু বাড়তি সুবিধা দিইনি।
সেটা পাগলার দরকার হবে কেন!
দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটার পর একটা ইনজুরিতে পড়েছে। প্রতিটা ইনজুরি ওর ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার মতো যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু নিজের চেষ্টায়, একমাত্র নিজের চেষ্টায় ভীষণ কষ্টকর সেই পুনর্বাসন-পর্ব শেষ করে ফিরে এসেছে প্রতিবার; আগের চেয়েও পরিণত হয়ে ফিরেছে। এমন লোকের পক্ষপাতের দরকার হয় না।
হ্যাঁ, জীবনে কখনো কখনো হয়তো সহজ রাস্তা খোঁজ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একটা কথা খুব তীব্রভাবে জানত যে, ও সাফল্য চায়। ইনজুরি থেকে প্রতিবার ফিরে আসার এই যে আপ্রাণ চেষ্টা, এটাই আসলে প্রমাণ করে, ও এই ক্রিকেট খেলাটায় থাকতে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকতে কতটা তীব্রভাবে চায়। আমি শুধু ওর এই ভীষণ চেষ্টা দেখে একটু পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, সমর্থন দিয়েছি।
ইনজুরিকে বারবার এড়িয়ে ফিরে এসেছে বটে। তবে এই ইনজুরি আসলে মাশরাফির সেরাটা দেখতে দিল না। একটা তো সোজা হিসাব, ইনজুরির ফলে পাগলা মোট কতগুলো ম্যাচ খেলতে পারেনি, কতটা বছর জীবন থেকে তার হারিয়ে গেছে, সেটা হিসাব করলে ধারণা পাওয়া সম্ভব যে, আরও কতগুলো উইকেট তার থাকতে পারত।
কিন্তু এই হিসাবটা আমরা করব, বারবার ইনজুরিতে পড়ে ক্ষমতা হারাতে থাকা, ছন্দ হারাতে থাকা একজন মানুষের বোলিং গড় দেখে। পাগলা যদি কখনোই ইনজুরিতে না পড়ত, যদি সে সব সময়ই তার শুরুর শারীরিক সমার্থ্যটা ধরে রাখতে পারত, সে ক্ষেত্রে যে কয়টা ম্যাচ খেলেছে, তাতেও উইকেটসংখ্যা থাকত চোখে পড়ার মতো। আমি এককথায় মনে হয় বলতে পারি, ইনজুরি এভাবে বারবার এসে ওকে লাইনচ্যুত করে না দিলে, সে সম্ভবত গ্রেট ফাস্ট বোলারদের একজন হয়ে উঠত।
তবে ইনজুরি পাগলার কাছ থেকে যেমন অনেক সময় ও উইকেট কেড়ে নিয়েছে, তেমনই পাগলা এই বিরাট অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অসাধারণ পরিণত হয়ে উঠেছে। আমি টেলিভিশনে ওর খেলা দেখি এখন। পাগলার হয়তো সেই গতি নেই, যা দিয়ে একসময় সে আতঙ্ক তৈরি করত। তবে পাগলা এখন জানে, অফ স্টাম্প কোথায় থাকে। এই যে পরিণত হয়ে ওঠা, এই মানসিকভাবে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠা; এটা পাগলাকে দারুণ এক নেতায় পরিণত করেছে।
হ্যাঁ, তার মধ্যে একটা নেতৃত্বগুণ অন্তত ছোটবেলা থেকেই দারুণভাবে ছিল। দলের প্রতিটা খেলোয়াড়ের জন্য, আসলে প্রতিটা মানুষের জন্য ওর ভেতরে একটা মানবিক আবেগ আছে। ওর আশপাশে থাকা প্রতিটি মানুষকে আলাদা করে ভালোবাসতে চায়। এটা আপনাকে নেতা হিসেবে অনেক বড় করে তুলবে, এ রকম গুণ থাকলে আপনার দলের প্রত্যেকে আপনার প্রতি দারুণ নিবেদিত হবে। আজকের পাগলা নিশ্চয়ই ওই গুণের সর্বোচ্চ প্রতিদান পাচ্ছে।
মাশরাফি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তাকে করে তুলেছে এক দারুণ নেতা। প্রতিটি ইনজুরি থেকে ফেরার পর তাকে লড়তে হয়েছে। যেকোনো একটা বিরতির পর এসে দলের অংশ হওয়াটা আরেকটা লড়াই। পাগলা বারবার লম্বা বিরতির পর ফিরে এসে দলের অংশ হয়েছে এবং দলের সবার প্রিয় চরিত্রই থেকেছে; এটাকে আপনার খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এতে তার সতীর্থদের সঙ্গে মেশার ক্ষমতাটা বোঝা যায়।
অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, দায়িত্ববোধ বাড়ে এবং নেতৃত্বগুণ তৈরি হয়। আর এই সবকিছু মিলিয়ে আমি বলব, পাগলা এখন ওয়ানডে ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য এক অধিনায়ক হয়ে উঠেছে।
এটা সবাই মানবেন যে, মাশরাফির জীবনের মতো নাটকীয় জীবন, গল্পের জীবন খুঁজে পাওয়া কঠিন। মানুষকে যেমন আনন্দে হাসায়, নিজেকে অনেক কাঁদতে হয়েছে। আমি বাংলাদেশ ছাড়ার পরও ঘটনাক্রম অনুসরণ করেছি। ২০১১ বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়াটা পাগলার জীবনের একটা বড় ট্র্যাজেডি ছিল। এটা ঠিক কি ভুল বলার মতো অবস্থায় আমি নেই। হয়তো ক্রিকেটীয় কারণেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তবে এটুকু বলতে পারি, এমন হাসি-কান্নার নাটকীয়তাতেই ভরা পাগলার জীবন।
ঘটনাক্রমে আমি এবার যখন ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া এসেছি, ঠিক তখনই ডিএম (দেবব্রত মুখার্জি) জানাল, সে পাগলার এই নাটকীয় জীবনটা লিখে রাখতে চায়, একটা জীবনী লিখতে চায়। এর চেয়ে দারুণ উদ্যোগ আর হতে পারে না। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, বিশ্বের অনেক অসাধারণ ক্রিকেটার ও মানুষের মতো পাগলার সংস্পর্শে কখনো আসতে পেরেছিলাম।
আজ আরও সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে যে, ডিএম আমাকে পাগলার জীবনীর জন্য কিছু লিখতে বলেছেন। এটা আমার জন্য একটা প্রাপ্তি।
আমি নিশ্চিত নাটকীয় এই জীবনকাহিনী পড়ে লোকেরা আনন্দিত হবেন, ভবিষ্যতের তরুণ ক্রিকেটাররা অসাধারণ অনুপ্রেরণা পাবেন নিজেদের বড় করার ব্যাপারে।
বইয়ের জন্য শুভকামনা রইল। শুভকামনা রইল প্রিয় সাংবাদিক ডিএম-এর জন্য।
আর একজন ক্রিকেটার, একজন মানুষের জন্য আমার সারা জীবনের অন্তহীন ভালোবাসা ও শুভকামনা-পাগলা। ভালো থেকো, পাগলা। সৌজন্যে : ‘মাশরাফি’ ও মানবজমিন
২৮ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি