মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৬:১৮:০৭

ধোনিকে বাঁচাতে ভারতের সবাই একাট্টা

ধোনিকে বাঁচাতে ভারতের সবাই একাট্টা

দেবাশিস দত্ত: আরও একটা মনখারাপের সকাল, দিন, সন্ধ্যা এবং অবশ্যই রাত। নিজে ম্যাঞ্চেস্টারের মাঠে উপস্থিত ছিলাম। তিন দিনেরও কম সময়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই টেস্ট। ইংল্যান্ড জিতেছিল ইনিংস এবং ৫৪ রানের ব্যবধানে।

এবং সফরের ম্যানেজার ১৮ মাস পর বললেন, লুকোনো ক্যামেরার সামনে যে, ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ওই টেস্ট ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সবার প্রশ্ন, এতদিন পর কেন সফরে ম্যানেজার হিসেবে যাওয়া সুনীল দেব এমন মারাত্মক একটি অভিযোগ করলেন? যে প্রশ্নগুলো আমরা ১৮ মাস আগে ম্যাচ হারার পর, ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে আলোচনা করেছিলাম, হুবহু একই প্রসঙ্গ তুলেছেন সুনীল।

আগের তিন–চার দিনের বৃষ্টিতে ম্যাঞ্চেস্টারের উইকেটে স্যাঁতসেঁতে ভাব ছিল। তবু টস জিতে ধোনিরা ব্যাটিং করতে চাইলেন। ভারত প্রথম ৪ উইকেট হারিয়েছিল ৮ রানে, ৫.১ ওভারে। জিওফ বয়কট পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, ‘কেন টসে জিতে ভারত ব্যাট করল? মুরলী বিজয়, গৌতম গম্ভীর, চেতেশ্বর পুজারা এবং বিরাট কোহলি ফিরে গিয়েছিলেন ওই সময়। ভারত কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে ১৫২ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ধোনি করেছিলেন ৭১ রান। ভারতীয় শিবিরে সর্বোচ্চ।

সুনীল দেব সরাসরি অভিযোগ করলেন ধোনির বিরুদ্ধে, যিনি কিনা দলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত গুটিয়ে গিয়েছিল আরও জলদি। ৪৩ ওভারে। রান সামান্য বেশি, ১৬১। দ্বিতীয় ইনিংসে ধোনি করেছিলেন ২৭ রান। এবার সর্বোচ্চ রান পেলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন, ৪৬ অপরাজিত। ওই টেস্টেই নাক ভেঙে গিয়েছিল স্টুয়ার্ট ব্রডের।

যিনি প্রথম ইনিংসে ২৫ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে ম্যাচ থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন। নাকে প্লাস্টার লাগিয়ে নিতে এসেছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার।
এখন প্রশ্ন, সফরের ম্যানেজার কেন নিজের দলের বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ আনলেন? গোপন ক্যামেরার সামনে যে যুক্তি মেলে ধরেছেন, তাতে আছে ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা।

আকাশ মেঘলা, টানা বৃষ্টির প্রভাব, উইকেটে স্যাঁতসেঁতে ভাব— এই অবস্থায় টস জিতে বিপক্ষকে ব্যাটিং করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল টিম মিটিংয়ে। কিন্তু, ধোনি নিয়েছিলেন উল্টো সিদ্ধান্ত। ভারত, সত্যি কথা বলতে কী, প্রথম ঘণ্টাতেই ম্যাচ থেকে ছিটকে গিয়েছিল। এই কারণের জন্যই সরাসরি অধিনায়ক ধোনির বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক একটি অভিযোগ আনা যায়? শিবিরে ছিলেন নিজে। হয়ত আরও কিছু হাতেগরম প্রমাণ বা পিলে–চমকানো তথ্য ছিল, যাতে কিনা তিনি ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার গন্ধ পেয়েছিলেন। সুনীল জানাচ্ছেন, নিজে তৎকালীন বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের অফিসে গিয়ে এই মর্মে লিখিত বিবৃতি দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শ্রীনি সেটা নিয়ে বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেননি।

লুকোনো ক্যামেরায় কী মেজাজে কথা বলেছিলেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু দিল্লির ওই হিন্দি সংবাদপত্র গোটা ব্যাপারটা ফাঁস করে দেওয়ার পরই টনক নড়ে যায় সুনীলের। এবং অবশ্যই ভারতীয় বোর্ড কর্তাদের। একে রামে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব। পরিস্থিতি অনেকটা তেমনই। সুপ্রিম কোর্ট এবং লোধা কমিশন নিয়ে জেরবার হয়ে থাকা বোর্ডে এসে পড়ল আরও একটি ধাক্কা। যা অনুধাবন করে দ্রুত বোর্ড কর্তারা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠলেন।

শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, এরকম একটি মারাত্মক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরও ভারতবর্ষের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল সোমবার ব্যাপারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল না। কার অঙ্গুলিহেলনে? আমরা সবাই জানি, ক্রিকেট–জুয়া এমন একটি চক্র, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সমাজের ছোট–বড়, নানা মাপের বিশিষ্টজনেরা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যিনি অভিযোগ করলেন, তিনি নিজেই সোমবার সকাল থেকে বলতে শুরু করেছেন, ‘এমন কিছু আমি বলিনি।’ মহা মুশকিল! ক্যামেরা, ছবি তো মিথ্যে কথা বলে না বলে এতকাল শুনে এসেছি।

কিন্তু সুনীল দেব যেভাবে ডিগবাজি খাওয়ার চেষ্টা করলেন, তাতে ক্রিকেট দুনিয়া স্তম্ভিত। বোর্ড এই মুহূর্তে নতুন করে আর ক্রিকেট–জুয়া বিতর্ক মাথা তুলতে দিতে নারাজ। তাই অধিনায়ক ধোনিকে এ ব্যাপারে মুখ না খোলার পরামর্শ দিয়েছে। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় কর্তারা যে যার মতো করে, নিজের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী প্রচারমাধ্যমে ব্যাপারটা নাড়াচাড়া না–করার অনুরোধ জানাতে শুরু করেন। অনেকটা সফলও তারা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এদিন সকালে যখন দিল্লিতে সুনীল দেবের সঙ্গে কথা হল আজকালের।

• এত বড় একটা অভিযোগ করতে ১৮ মাস লেগে গেল?
সুনীল দেব: ম্যায়নে তো কুছ বোলাই নেহি।
• মানে? ক্যামেরায় তো দেখানো হল যে, আপনি অভিযোগ করছেন…
সুনীল দেব: ম্যায় কুছ বোলাই নেহি।
• বুঝলাম যে আপনি ডিগবাজি খাচ্ছেন।
সুনীল দেব: বললে তো ডিগবাজি খাওয়ার প্রশ্ন উঠবে। দেখবেন, কোনও টিভি চ্যানেল, বড়া বড়া নিউজ পেপার আউর কুছ নেহি ছাপেগা।
• বন্দোবস্ত হয়ে গেছে?
সুনীল দেব: আরে কুছ বোলাই নেহি। (হুমকি দিলেন ওই সংবাদপত্রকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার)

এভাবেই বহু সহজ অঙ্ককে জটিল করে ফেলে ক্রিকেট জুয়াড়িদের বিন্দাস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে সাহায্য করেছেন। ধোনি গট–আপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টের সঙ্গে, এ কথা আমরা বলছি না। কিন্তু রাতারাতি গোটা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার উদ্যোগ কেন নিতে হচ্ছে বোর্ডকে? নতুন করে ক্রিকেটের শুদ্ধিকরণের প্রস্তুতি যখন, অন্তত সরকারিভাবে, বোর্ড নিতে চাইছে, তখনই বোর্ড এত বড় একটা অভিযোগ পেয়েও কেন তাতে জল ঢেলে দিতে চাইছে? ঠাকুরঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি–র মতো ব্যাপার।

পুনশ্চ: সবচেয়ে অবাক হয়ে গেলাম মুদগল কমিশনের প্রধান বিচারপতি মুকুল মুদগল যেভাবে বিতর্কটাকে পাত্তাই দিতে চাইলেন না, ‘কই এমন তো কিছু শুনিনি। বোর্ডকে তো ই–মেল করে এই ঘটনার কথা আগেই জানানো যেত। ব্যাপারটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ আমরা কি জানতে চাইতে পারি, যদি গুরুত্বপূ্র্ণ না–ই হবে, তবে লিখিত বিবৃতি দেওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন বোর্ড সভাপতি চেপে গিয়েছিলেন কেন?

মাননীয় বিচারপতি মুকুল মুদগলকে জানানো দরকার যে, সফরের ম্যানেজার নিজে এসে লিখিতভাবে এই অভিযোগ শ্রীনি–র হাতে তুলে দিয়েছিলেন? সুনীল দেব যে এখন ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছেন, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। বুঝতে পারলাম না, এমন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা হয়েও সুনীল কি আগে এই ‘চাপ’–এর কথা অনুমান করতে পারেননি? তা হলে বিপ্লবী হওয়ার শখ কেন হয়েছিল? -আজকাল

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে