সাইদুজ্জামান : জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে সোজা ছক্কা মারা ১৭ বছরের বাংলাদেশি তরুণকে নিয়ে যখন উন্মাতাল ক্রিকেট বিশ্ব, তখন দিল্লির বয়সভিত্তিক ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ত্রিনিদাদে বিস্ফোরক ইনিংস খেলা সেই তামিম ইকবাল পরশু রাতে বিছানায় গা এলিয়ে বিরাটের ইনিংস দেখে একটা বিশেষণই ব্যবহার করলেন, ‘ওয়ান অ্যান্ড ওনলি!’
বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল ত্রিনিদাদে ভারতকে বিশ্বকাপে ছিটকে দেওয়ার পরপরই ট্রান্স ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস টিভি চ্যানেল দিল্লিতে ইন্টারভিউ করেছিল এক ভারতীয় তরুণের। না, ভারতের বিশ্বকাপ থেকে সম্ভাব্য ছিটকে পড়ার প্রতিক্রিয়া নিতে নয়, টিভি রিপোর্টারের কৌতূহল ছিল ভারতীয় যুবদলের অধিনায়কের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য জানার।
কোহলি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি মূলত আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। বোলারকে তেড়েফুঁড়ে মাঠের বাইরে তুলে মারাই আমার পছন্দ।’ তখনো রাজ্য দলেই ঘোরাঘুরি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একদমই অচেনা বিরাট। তবু সেদিনই ঠিক করেছিলেন, ‘কাজটা কঠিন, প্রতিনিয়ত আপনাকে বড় বড় ইনিংস খেলতে হবে। অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে হবে। হয়তো তাতেও সবার মন ভরবে না, তবে আমি চেষ্টা করব মন ভরাতে।’
কোটি ভক্তের মন ভরিয়ে শত্রুশিবিরের তামিমের প্রশংসাও পাচ্ছেন আজকের কোহলি, ‘টি-টোয়েন্টি যে স্রেফ ব্যাটসম্যানশিপ দিয়েও জেতা যায়, সেটা কাল ও দেখিয়ে দিল। শেষদিকে দুটি টি-টোয়েন্টির শট খেলতে গিয়ে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে নিজের খেলাটাই খেলেছে। একটা ছেলে বারবার দলকে ম্যাচ জিতিয়ে দিচ্ছে, দারুণ ব্যাপার! এমনটা আমি দেখিনি।’
দেখেননি বলে ঠিক যতটা মুগ্ধ, মুহূর্তেই ততটা বিষণ্নতায় আক্রান্ত তামিম, ‘ভারতের সঙ্গে ৩৫ রান করে ওভাবে আউট না হয়ে আমার উচিত ছিল ম্যাচটা শেষ করে আসা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেভাবে না হলেও ইদানীং বিভিন্ন টুর্নামেন্টে লম্বা ইনিংস খেলেছি। বিরাটের ইনিংসটা দেখতে দেখতে তাই খুব অনুতাপ হচ্ছিল। আমিও তো...।’
শুধু তিনি কেন, কোহলির বছর তিনেক আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত মুশফিকুর রহিম কিংবা ত্রিনিদাদের অবিস্মরণীয় ম্যাচে ফিফটি করা সাকিব আল হাসানের যে কেউই বাংলাদেশের ‘বিরাট’ হয়ে উঠতে পারতেন। ম্যাচসংখ্যায় তো কেউই ভারতীয় ব্যাটিং সুপারস্টারের চেয়ে পিছিয়ে নেই। ওয়ানডেতে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে বিরাট, তবে টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি তার চেয়ে বেশিই খেলেছেন বাংলাদেশের তিন তারকা।
অথচ এ ত্রিভুজের সব ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি যেখানে ৩০টি, সেখানে বিরাট কোহলির ৩৬টি। এগুলো তো নিছকই পরিসংখ্যান, প্রচণ্ড চাপের মুখে কোহলির নিয়মিত বিরাট হয়ে ওঠাটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধান মনে করেন তামিম, ‘আত্মবিশ্বাস। টেকনিকে ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান বিশ্বে অভাব নেই। কিন্তু কজন পারছে ওরকম চাপের মধ্যেও পারফর্ম করতে? ওর সঙ্গে হাই হ্যালো ছাড়া ওভাবে কথা হয়নি। দূর থেকে দেখে যেটুকু বুঝি তাতে ওর আত্মবিশ্বাসই চোখে পড়ে বেশি, যেন মন থেকে বিশ্বাস করে ওর পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। হয়তো এ জায়গাটাতেই আমি কিংবা আমরা পিছিয়ে।’
এই আত্মবিশ্বাসের ‘রেসিপি’ খুঁজতে গিয়ে শুকনো একটা রসিকতাই মনে এসেছে তামিমের, ‘ওটা তো আর কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না!’ আত্মবিশ্বাসের উৎসটা কি তাহলে দীর্ঘ ক্রিকেট সংস্কৃতির উৎস? যুব ক্রিকেটে নাম লেখানোর আগেই শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো গ্রেটদের দেখেছেন, তাদের সঙ্গে খেলেছেনও কোহলি। সফল একটি ড্রেসিংরুমে অভিষেকই কি তাকে বিরাট হওয়ার আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে?
এমন প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর নেই তামিমের কাছেও, ‘এটা ঠিক যে যত ভালো দলে আপনি খেলবেন, তত ভালো করার সম্ভাবনাও বাড়ে। কোহলিকে ছোট একটা দলে ঠেলে দিলে হয়তো তার প্রমাণও পাওয়া যেত। তার মানে এই না যে ছোট দলে বড় তারকা হয় না। আমাদের একজন (সাকিব আল হাসান) বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েছে। একজন ডাবল সেঞ্চুরি করার পর আরেকজন ট্রিপল সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখছে। আসলে সত্যি বলতে কি, ওর আত্মবিশ্বাসের রহস্যটা আমার জানা নেই। আর একটা কথা মনে রাখবেন, কোহলি একজনই। রোনালদো কিংবা মেসি যেমন।’
তেমন একজনকে কি বাংলাদেশ কখনো পাবে? এবার মুগ্ধতা আর বিষণ্নতার মোড ফেলে চনমনে তামিম, ‘কেন নয়? একজন ক্রিকেটারের শেষ চার-পাঁচ বছর সেরা ক্রিকেটটা খেলে। আমাদের দলের কয়েকজন সে জায়গায় আছে। নতুন কেউও সেরকম হয়ে উঠতে পারে। অপেক্ষা করুন!’
তবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আর অপেক্ষা করার দরকার মনে করছেন না তামিম ইকবাল। এশিয়া কাপ এবং ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিরাট কোহলির ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পর বিশেষজ্ঞরা পরোক্ষে টেন্ডুলকারের চেয়েও উঁচুতে বসিয়ে দিচ্ছেন তাকে।
বরাবরের টেন্ডুলকারভক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই তামিমের, ‘আপত্তি করবো কেন? এটা তো শুধু পরিসংখ্যানের ব্যাপার না, যে পরিস্থিতিতে এসব করছে, সে বিবেচনায় আমার কাছে কোহলি ওয়ান অ্যান্ড ওনলি!’ -কালেরকণ্ঠ
২৯ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস