সোমবার, ৩০ মে, ২০১৬, ০১:০১:২৭

মায়ের লাশ রেখে মেয়েকে যেতে হয়েছে পরীক্ষার কেন্দ্রে

মায়ের লাশ রেখে মেয়েকে যেতে হয়েছে পরীক্ষার কেন্দ্রে

নিউজ ডেস্ক: বাড়িতে আসছে মায়ের লাশ। এমন খবরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল চম্পা। এরপরও তাকে বসতে হয়েছে পরীক্ষার হলে। নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে চম্পা রাণী সূত্রধর। কিন্তু মায়ের লাশের অপেক্ষায় থেকে থেকে তো তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। এরপরও পাড়া-প্রতিবেশীদের টানা-হেঁচড়ায় তাকে যেতে হয়েছে পরীক্ষা কেন্দ্রে। সমাজকর্ম প্রথমপত্রের নির্ধারিত পরীক্ষার পুরো সময়টাই যেন তার কাছে এক দুঃসহ সময়। জীবনের পরীক্ষায় যেখানে বারবার তাকে পরাজিত হতে হচ্ছে, একাডেমিক পরীক্ষা তার কাছে তো এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। সেই ছোট্ট বয়সে বাবা নারায়ণ সূত্রধরকে হারিয়ে মাকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে পেয়ে আসছিল চম্পা। এবার সর্বনাশা এক ট্রলারডুবিতে হারাতে হলো সেই মা বিউটি রাণী সূত্রধরকে। মাথার ওপর যে আর কোনো ছায়াই রইলো না তার। একমাত্র বড় ভাই অর্জুন (২০)-ও যেন পাগল হয়ে গেছে। কোনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মায়ের এই করুণ মৃত্যু। দুটি ভাইবোনের সব আশার প্রদীপই যেন ধপ করে নিভে গেলো নিয়তির নির্মম ঝাপটায়। রোববার সকালেই বাড়ি ফেরার কথা ছিল বিউটি রাণী সূত্রধরের। দুপুরে তিনি ফিরলেনও। কিন্তু লাশ হয়ে।

রোববার ভোর পাঁচটার দিকে মিঠামইন উপজেলা সদরের লঞ্চঘাট এলাকার ঘোড়াউত্রা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় মারা যান পাঁচ নারী আনসার সদস্য। নিহতের সেই তালিকায় রয়েছেন বিউটি রাণী সূত্রধরও। পার্শ্ববর্তী মিঠামইন উপজেলায় ইউপি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তারা। কিন্তু ট্রলারটি মিঠামইন লঞ্চঘাট থেকে ছাড়তে না ছাড়তেই অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে ডুবে যায়। এতে বিউটি রাণী সূত্রধর (৩৮) ছাড়াও মারা যান আরো চার নারী আনসার সদস্য। তারা হলেন, সাবিনা আক্তার (৪৫), হাসনা আরা (৩৫), মোমেনা আক্তার (৪৫) ও আম্বিয়া বেগম (৩৫)। নিহতরা সবাই নিকলী উপজেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে হাসনা আরা নিকলী উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী মেম্বার এবং আনসার ও ভিডিপির দামপাড়া ইউনিয়নের দলনেত্রী।

তিনি ইউনিয়নের মধ্যকামালপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী। হাসনা আরা আক্তারের দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে পিংকি বড় এবং ছেলে রাহাতুল ছোট। দামপাড়া কারার মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে পিংকী নবম শ্রেণীতে এবং রাহাতুল ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। নিহত অন্যদের মধ্যে সাবিনা আক্তার একই ইউনিয়নের উত্তর দামপাড়া সাহেবের হাটির হাবিব মিয়ার স্ত্রী, বিউটি রাণী সূত্রধর দামপাড়া টেকপাড়ার মৃত নারায়ণ সূত্রধরের স্ত্রী, আম্বিয়া বেগম জারুইতলা গ্রামের ফজলু মিয়ার স্ত্রী এবং মোমেনা আক্তার জারুইতলা ইউনিয়নের সাজনপুর গাছতলা গ্রামের আবদুল মান্নানের স্ত্রী। এদিকে ট্রলারডুবির খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান, আনসার ও ভিডিপির জেলা কমান্ডার মো. আমজাদ হোসেন, সার্কেল এডজুটেন্ট এসএম শরীফুল আলম ঘটনাস্থলে ছুটে যান।


প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া আনসার সদস্যরা জানান, শনিবার অনুষ্ঠিত মিঠামইন উপজেলার ইউপি নির্বাচন শেষে দায়িত্বপালনকারী নিকলী উপজেলার আনসার সদস্যরা মিঠামইন উপজেলা কমপ্লেক্সে রাত্রিযাপন করেন। রাত্রিযাপন শেষে রোববার ভোরে তারা বাড়িতে ফেরার জন্য মিঠামইন বাজার লঞ্চঘাটে যান। ঘোড়াউত্রা নদীর পাড়ের লঞ্চঘাট থেকে তারা নিকলীগামী একটি ট্রলারে ওঠে বসেন। ৬০-৭০ জন আনসার সদস্য নিয়ে ট্রলারটি রওনা হওয়ার পরপরই যাত্রীদের হুড়োহুড়ির কারণে উল্টে গিয়ে ঘাটের কাছেই ডুবে যায়। এতে ট্রলারে থাকা অন্তত ২০ জন্য নারী আনসার সদস্য ট্রলারের ভেতর আটকা পড়েন। এদিকে ট্রলারডুবির পর পরই পুলিশ ও এলাকাবাসী উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। উদ্ধার তৎপরতার একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঘোড়াউত্রা নদী ও ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে সাবিনা আক্তার, বিউটি রাণী সূত্রধর, হাসনা আরা ও মোমেনা আক্তার- এই চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আম্বিয়া বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে সেখান থেকে দুপুরের দিকে আনসার ও ভিডিপির জেলা কমান্ডার মো. আমজাদ হোসেন ও সার্কেল এডজুটেন্ট এসএম শরীফুল আলমের তত্ত্বাবধানে নিহত পাঁচজনের লাশ নিকলীতে নিয়ে গিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিকলীতে তাদের লাশ নিয়ে আসার পর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। এ সময় ঢাকা থেকে আনসার ও ভিডিপির উপমহাপরিচালক দিলীপ কুমার বিশ্বাস ও ঢাকা রেঞ্জের পরিচালক শহীদুল আলম নিকলীতে গিয়ে নিহতদের দাফন কার্যক্রমের তদারকি ও পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।

আনসার-ভিডিপির জেলা কমান্ডার মো. আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, আনসার-ভিডিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মিজানুর রহমান প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে অনুদান ঘোষণা করেছেন। আর জেলা আনসারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা কমান্ডারের পক্ষ থেকে তাদের অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধাদিও প্রদান করা হবে। এদিকে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ৫০ হাজার করে টাকা দেয়া হবে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও ৫০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানিয়েছেন।-এমজমিন

৩০ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে