মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬, ০৫:২৬:৪৯

‘লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে মাকে খুঁজতে থাকি, পরে মায়ের লাশ মেলে’

‘লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে মাকে খুঁজতে থাকি, পরে মায়ের লাশ মেলে’

নাসরুল আনোয়ার: স্বামী নারায়ণ সূত্রধরের মৃত্যুর পর ঋণের টাকা শোধ করতে বিউটি রানী (৪৫) বসতবাড়ির একাংশ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক কথা শুনিয়েছে। দীর্ঘদিন তাঁকে প্রায় একঘরে করে রেখেছে। মেয়ে চম্পা আর ছেলে দীপনকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন পার করেছেন বিউটি। তিন বেলা খাবার আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হাতপাখা তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করেন। এসএসসি পাস করে চম্পা কলেজে ভর্তি হলেও অভাবের তাড়নায় দীপনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আয়ের আশায় একপর্যায়ে নিকলী উপজেলা আনসার ও ভিডিপির সদস্য হন বিউটি। নির্বাচন ও পূজা-পার্বণ এলে ডাক পড়ত তাঁর। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শুক্রবার রাতে গিয়েছিলেন মিঠামইন। কিন্তু আর ফেরা হয়নি।

গত রবিবার ভোরে মিঠামইনের ঘোড়াউত্রা নদীতে ট্রলারডুবিতে আরো চার নারী আনসার সদস্যের সঙ্গে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। বিউটির বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়ায়। একমাত্র অবলম্বন মাকে হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চম্পা ও দীপন। নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে চম্পা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। রবিবার তার সমাজকর্ম বিষয়ে পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা প্রস্তুতির মধ্যেই সকালে মায়ের মৃত্যুসংবাদ আসে। বিধ্বস্ত চম্পা সিদ্ধান্ত নেয় পরীক্ষা দেবে না। তবে এলাকাবাসী সান্ত্বনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে পরীক্ষার হলে পাঠায়। চম্পা বলে, “আজ (রবিবার) আমার পরীক্ষা থাকায় মাকে শুক্রবার মিঠামইনে যেতে মানা করেছিলাম। মা বলেছিলেন, ‘আমি ডিউটি না করলে তোদেরে দেখবে কে।’ এখন তো আমার শেষ ভরসাও শেষ হয়ে গেল।”

প্রতিবেশী গৃহবধূ সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘পুলাপানডিরে ছুডু থইয়া বাপ মইরা গেছিন। অহন তো মাও মরল। এরারে (চম্পা-দীপন) দেখবার আর কেউ নাই। মাইয়াডার লেহাফরা করাইব কেডা! বিয়াশাদিঅই অইব কেমনে!’ ট্রলারডুবিতে নিহত অন্যরা হলেন নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের উত্তর দামপাড়া গ্রামের সাবিনা আক্তার (৩৬), দামপাড়ার কামালপুর গ্রামের হাসনা আরা (৪৫), জারইতলা ইউনিয়নের সাজনপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৪০) ও জারইতলা গ্রামের ফজলু মিয়ার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম (৪২)।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রবিবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে বিউটিসহ চারজনের লাশ ট্রলারে করে দামপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় স্থানীয় ধনু নদীর ঘাটে ভিড় করে হাজারো শোকার্ত মানুষ। ট্রলারডুবির ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে নিকলীর দামপাড়া, জারইতলা ও সাজনপুর গ্রাম। পারিবারিক সূত্র জানায়, একটু ভালোভাবে চলার জন্য হাসনা আরা আনসার সদস্য হয়েছিলেন। দুই ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মেয়ে প্রিয়াংকা দামপাড়া কারার মাহতাবউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। একমাত্র ছেলে পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। মাকে হারিয়ে এখন পাগল দশা তাদের। 

উত্তর দামপাড়া গ্রামের সাহেবেরহাটির আনসার সদস্য সাবিনা আক্তারকে ফেলে রেখে স্বামী মো. হবি মিয়া অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন। একমাত্র ছেলে রানাও মায়ের পথ ধরে আনসার সদস্য হয়েছিল। গত শনিবার মায়ের সঙ্গেই নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করে রানা। ফেরার সময় সেও মায়ের সঙ্গে একই ট্রলারে উঠেছিল। তবে মাকে বাঁচাতে পারেনি। মায়ের লাশ জড়িয়ে ধরে বারবার মূর্ছা যায় সে। এক ফাঁকে অনেক কষ্টে জানায়, গতকাল ভোরে সে ট্রলারের গলুইয়ের ওপর বসেছিল। মা ছিলেন নিচে, ছইয়ের ভেতর। হঠাৎ ট্রলারটি কাত হয়ে ডুবে যেতে থাকলে সে লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে মাকে খুঁজতে থাকে। পরে মায়ের লাশ মেলে। নিহত আম্বিয়া বেগমের স্বামী ফজলু মিয়া বলেন, ‘আম্বিয়াসহ বেশ কয়েকজন নারী আনসার সদস্য ট্রলারটির ভেতর অবস্থান করছিল। ট্রলারের জানালা ভেড়ানো ছিল। ভিড়ের চাপে ট্রলারটি ডুবতে শুরু করলে ভেতর থেকে আম্বিয়া আর বের হতে পারেনি।’ ফজলুও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে স্ত্রীর সঙ্গে মিঠামইন গিয়েছিলেন।    

স্থানীয়রা জানায়, রাস্তায় মাটি ভরাট আর মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কায়ক্লেশে দিন কাটছিল মোমেনা বেগমের। আরেকটু সুখের আশায় আনসার সদস্য হয়েছিলেন মোমেনা। এসব করে করে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। শ্রমসাধ্য কাজ করতে না পেরে স্বামী আব্দুল মান্নানও প্রায় বেকার। ট্রলারডুবিতে মোমেনা নিহত হওয়ায় মান্নানের পরিবারটি তছনছ হয়ে গেল।-কালের কণ্ঠ

৩১মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে