কিশোরগঞ্জ : ‘আমাকে লুঙ্গি দিতে গিয়ে প্রাণ হারালেন মা। মাকে হাসপাতালে নেয়ার মতোও সুযোগটুকু পায়নি। চোখের সামনেই মার মৃত্যু হলো, কিছুই করতে পারলাম না। কি করে মনটাকে বুঝাই? ঘরে থেকেও মানুষের নিরাপত্তা নেই। কোন দেশে বসবাস করি’!
এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা হারানোর শোকে আহাজারি করছিলেন ঝর্ণা রানীর বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক।
স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক ও ছোট ছেলে শুভদেব ভৌমিককে নিয়ে শোলাকিয়া সবুজবাগ মহল্লায় থাকতেন ঝর্ণা রানী। বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক ঢাকার তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক।
অনেকদিন পর বড় ছেলে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। তার আগমনে মা-বাবা খুশিতে আত্মহারা। ঈদের দিন সকালে প্রতিবেশিদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে মা রুটি ও সেমাই তৈরি করতে বসেন রান্নাঘরে।
তখন সকাল সাড়ে ৯টা। হঠাৎ ঘরের বাইরে গোলাগুলি ও চিৎকারের শব্দ শুনতে পান ঝর্ণা রানী। এ সময় বড় ছেলে বাথরুমে গোসল করছিলেন। জানালা দিয়ে ভয়াবহ গোলাগুলি দেখে দরজা-জানালা বন্ধ করে সবাই ঘরের বিছানায় বসে পড়েন।
এসময় বড় ছেলে বাথরুমের ভেতর থেকে বলছেন মা, তাড়াতাড়ি লুঙ্গি দাও। আমি বের হই। এসময় মা ঘরের বারান্দা থেকে লুঙ্গি নিয়ে ছেলেকে দিতে জানালার পাশে বাথরুমের দরজায় যান। ঠিক তখনই টিনসেটের জানালা ভেদ করে গুলি এসে লাগে ঝর্ণা রানীর ঠিক মাথায়। সেই গুলি কপাল দিয়ে বের হয়ে যায়।
তখন তিনি ভেতরের মেঝেতেই পড়ে যান। ঘরের মেঝে ভেসে যায় রক্তে আর রক্তে। পরিবারের সদস্যরা চেষ্টা করেছিলেন হাসপাতালে নেয়ার কিন্তু বাইরে চলছিল পুলিশ ও জঙ্গিদের যুদ্ধ। বৃষ্টির মতো চলে দু’পক্ষের গুলি বিনিময়। শেষ পর্যন্ত ছেলের কোলেই চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ঝর্ণা রানী।
রান্নাঘরে মায়ের রান্না করা সেমাই আর ময়দার গোলা দেখিয়ে ছেলে বাসুদেব কান্না করে বলছিলেন, আমার জন্যই আজ মা পৃথিবীতে থেকে চলে গেল। আমি যদি লুঙ্গির জন্য এসময় ডাক না দিতাম তাহলে তিনি বেঁচে থাকতেন। আমার চোখের সামনেই ঘরটা ভেসে গেল মায়ের রক্তে। একটু সুযোগও পেলাম না হাসপাতালে নেয়ার।
ঝর্ণার স্বামীর নাম গৌরাঙ্গ ভৌমিক। গৌরাঙ্গ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, গোলাগুলির সময় সবাই তখন বিছানায় শুইয়া আছিলাম। ভগবান আমাকে না নিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেল কেন? আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া মাঠের দেড়শ’ গজ পশ্চিম পাশে সবুজবাগ মহল্লায় বাসুদেবদের বাড়ি। বাসুদের বাড়ি থেকে ১০ গজ দূরেই ছিল মূল ঘটনাস্থল।
নিহত ঝর্ণা রানীর শেষকৃত্য বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই শেষ হয় বলে জানিয়েছেন পরিবারের লোকজন। করিমগঞ্জ-তাড়াইলের সাংসদ শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ও রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে সাংসদ রেজোয়ান আহম্মেদ তৌফিক, জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমানসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শুক্রবার সকালে নিহত ঝর্ণা রানীর পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে তাদের বাড়ি আসেন এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের পাশে জঙ্গিদের বোমা হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাসহ আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ জনে। মারা গেছে পুলিশসহ চারজন।
শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশাররফ হোসেন আহতদের সংখ্যা নিশ্চিত করেন।
৮ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম