আসিফুর রহমান ও তাফসিলুল আজিজ শোলাকিয়া (কিশোরগঞ্জ) থেকে: শফিউল আলমকিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে হামলাকারীরা এক সপ্তাহ আগে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ওই বাসা শহরের নীলগঞ্জ মোড়ের পাশে, ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে। এ ঘটনায় আটক জঙ্গি শফিউল ইসলাম আগেও পঞ্চগড়ে গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
গতকাল রোববার ওই বাসা থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত দল বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। এ ঘটনায় সদর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা হয়েছে।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, গত ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীশ্রী সন্ত গৌড়ীয় মঠে গিয়ে যজ্ঞেশ্বর চন্দ্র রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ মামলায় অভিযুক্ত ১০ জনের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনার পর পুলিশ জানতে পারে আটক শফিউল আলম পলাতক ৬ জনের একজন। পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার যজ্ঞেশ্বর হত্যায় শফিউলের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ‘পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে খুঁজছিল।’
যজ্ঞেশ্বর হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মোটরসাইকেলে করে যে তিনজন মঠে আসে, তাদের মধ্যে শফিউলও ছিলেন। শফিউল আগের দিন রাতে এসে স্থানীয় জঙ্গি ও ওই মামলার পলাতক আসামি দেবীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব দেবীডুবা গ্রামের সাইদুল ইসলামের ছেলে মো. রানার বাড়িতে রাত যাপন করেন। এই বাড়ি থেকেই মোটরবাইকে করে মাঠে যান।
মামলার বাদী পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হামলাকারীরা ঈদের দিন সকাল নয়টার দিকে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা ধরে ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিল। তাঁর ধারণা, হামলাকারীরা রেললাইন ধরে এ পথে এসেছে।
প্রসঙ্গত, নীলগঞ্জ মোড়ের ওই বাড়ি থেকে রেললাইন ধরে মাঠে যাওয়া যায়। এ ছাড়া এখান থেকে বিকল্প বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে।
অবশ্য হামলাকারীরা ওই বাসায় ছিল কি না, তা বাড়ির মালিক বা আশপাশের কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। ওই বাসার মালিকের মেয়ে বলেন, বাসা ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি দেখে ১ জুলাই ১৮-১৯ বছরের এক যুবক বাসা ভাড়া নিতে আসেন। তিনি নিজেকে জয়নাল আবেদিন, কিশোরগঞ্জের সরকারি গুরুদয়াল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র বলে পরিচয় দেন। ৪ জন থাকবেন বলে নিচতলায় বাসা ভাড়া চান। গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। ওই ছেলের কাছে পরিচয়পত্র চাইলে কলেজ বন্ধের কথা বলেন। জাতীয় পরিচয়পত্র ঈদের পর বাড়ি থেকে নিয়ে আসবেন বলে কথা দেন। ১ জুলাই বাসা খালি হলে ২ জুলাই ওই ছেলে ওঠেন। তবে তাঁর সঙ্গে আর কেউ বাসায় উঠেছিল কি না, তাঁরা জানেন না।
ঢাকা থেকে আসা সিআইডির সাত সদস্যের একটি তদন্ত দল ওই বাসা থেকে বেশ কিছু মালামাল জব্দ করে। তাঁরা দুই কক্ষের ওই বাসায় থেকে চারটি করে কাঁথা, বালিশ, গামছা, লুঙ্গি, ব্রাশ ইত্যাদি পান। তদন্ত দলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা বাসায় অন্তত ৪ জনের থাকার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। তবে ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে নিহত আবির রহমান ও আহত অবস্থায় আটক শফিউল ইসলাম ওই বাসায়ই ছিলেন কি না, তা তাঁরা নিশ্চিত নন। আশপাশের বাড়ি ও দোকানদারেরাও অবশ্য ওই বাসায় কে বা কারা ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুর্শেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়নাল আবেদিন নামে একজনের জড়িত থাকার বিষয়টি শুনেছি। মামলার প্রাথমিক তদন্ত করছি। আরও কয়েকটি সংস্থা তদন্ত করছে। হয়তো বৃহত্তর তদন্তে কিছু বের হতে পারে।’
জানা গেছে, সন্দেহভাজন জঙ্গি মো. শফিউল আলম (২০) পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায় হত্যায় সরাসরি জড়িত। এ মামলায় আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে শফিউল আলমের নাম উল্লেখ আছে।
সিআইডির তদন্ত দলের প্রধান, পরিদর্শক (ক্রাইমসিন) মো. শহীদুল্লাহ এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সামনে কোনো বক্তব্য দেননি। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আহত শফিউল নীলগঞ্জ মোড়ের ওই বাসায় থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হামলায় অন্তত আটজন জড়িত থাকার কথা বলেছেন শফিউল।
মামলার বাদী শামসুদ্দিন বলেন, হামলাকারীদের সঙ্গে ব্যাগ থাকায় তল্লাশি করতে গেলে তাঁরা পুলিশের দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। পরে কয়েকজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করেন ও গুলি ছোড়েন। তিনি বলেন, হামলার সময় দুজনকে শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে অবশ্যই আরও কয়েকজন ছিল।
ঈদের দিন (গত বৃহস্পতিবার) সকালে শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের আধা কিলোমিটারের মধ্যে ওই এলাকায় একদল পুলিশের ওপর জঙ্গিরা হামলা চালায়। তারা বোমা হামলা করে ও কুপিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। এরপর প্রায় চার ঘণ্টা পুলিশ, র্যা ব ও বিজিবির সঙ্গে জঙ্গিদের থেমে থেমে গোলাগুলি হয়। এতে এক জঙ্গি নিহত হয়। দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে স্থানীয় এক নারী নিজের ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। গুলি ও বোমায় আহত হন ১০ পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জন।
পুলিশের করা মামলায় ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে আহত অবস্থায় আটক শফিউল ইসলাম ও সন্দেহভাজন হিসেবে আটক জাহিদুল হককে আসামি করা হয়েছে। তবে জাহিদুল হককে তাঁর পরিবার মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করছে। পরিবারের দাবি, প্রায় দুই বছর আগে জাহিদুলের মা মারা যাওয়ার পর জাহিদুল মানসিক ভারসাম্য হারান।
এ বিষয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশাররফ হোসেন বলেন, জাহিদুল মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন বলে পরিবার জানিয়েছে। তাঁর সঙ্গে হামলাকারীদের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁকে ঘটনাস্থল থেকেই আটক করা হয়েছে।
পুলিশের কয়েকটি দলকে গতকাল ঘটনাস্থলে পাহারারত দেখা যায়। এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।-প্রথম আলো
১১ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস