শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬, ০১:০১:৪০

‘পরশমণি’র কক্ষেই মজুত করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র-বিস্ফোরক

‘পরশমণি’র কক্ষেই মজুত করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র-বিস্ফোরক

আশরাফুল ইসলাম: জঙ্গিদের ভাড়া নেয়া ‘পরশমণি’র কক্ষেই মজুত করা হয় শোলাকিয়া হামলার অস্ত্র ও বিস্ফোরক। ২রা জুলাই দুপুরে আনা হয় এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক। যার মধ্যে ছিল পিস্তল, গুলি, চাপাতি ও ইমেপ্রাভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)। পাঁচ জঙ্গি তাদের পিঠে বহন করা ব্যাগ ও পরনের প্যান্টের বিশেষ পকেটে ভরে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক বাসায় নেয়। হামলার চূড়ান্ত ছক সম্পর্কে তাদের আগেই ধারণা দেয়া হয়। হামলার অংশ নিতে কিশোরগঞ্জে আসার আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের একটি টিনশেডের পুরনো বাড়িতে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ।

তবে পাঁচ জঙ্গি কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের নীলগঞ্জ রোডের ৪৩২ হোল্ডিংয়ের ‘পরশমণি’ নামের ওই নির্মাণাধীন বহুতল ভবনটির নিচতলার পশ্চিম পাশের ইউনিটে একসঙ্গে অবস্থান করলেও তারা প্রত্যেকে পরিচিত ছিল ছদ্মনামে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় র‌্যাবের হাতে আটক শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে সাইফুল ইসলাম তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ১লা জুলাই রাতে সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয় রাজধানীর ডিপ্লোম্যাটিক জোন। এ ঘটনা ঘটার আগেই হামলার টার্গেট করা হয় শোলাকিয়ার বৃহত্তম ঈদ জামাতকে। টার্গেট সফল করার মিশন নিয়ে ১লা জুলাই দুপুরেই কিশোরগঞ্জে এসে বাসা ভাড়া নেয় সরকারি গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র পরিচয়ে জয়নাল আবেদীন ছদ্মনামের এক জঙ্গি। পরদিন ২রা জুলাই দুপুরে তার সঙ্গে এসে যোগ দেয় আরো চারজন। জঙ্গিদের ভাড়া নেয়া ‘পরশমণি’ ভবনের কক্ষ থেকে ১৫ মিনিটের মতো পায়ে হাঁটা দূরত্বের শোলাকিয়া ঈদগাহ কয়েক দফা রেকি করা হয়।

‘পরশমণি’ নামের ওই বাসাটির মালিক মো. আবদুস সাত্তার খাদ্য বিভাগের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তবে বাড়িওয়ালা মো. আবদুস সাত্তারের চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সন্তান সারোয়ার জাহান সায়েম আলোচিত ‘নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঘটনার দিন র‌্যাবের হেফাজতে চিকিৎসাধীন শরীফুল ইসলামের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সন্ধ্যায়ই বাসাটির অবস্থান নিশ্চিত হয় র‌্যাব।

এ সময় তারা বাসাটিতে তল্লাশি চালিয়ে জঙ্গিদের ব্যবহৃত রান্নার কড়াই, বাসনপত্র, চারটি বালিশ, তিনটি কম্বল ও কিছু বইপত্র পায়। এ ব্যাপারে বাড়িওয়ালা আবদুস সাত্তার ও তার ছেলে সারোয়ার জাহান সায়েমকে র‌্যাব কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের রাতেই ছেড়ে দেয়া হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা শোলাকিয়া হামলার সঙ্গে বাড়িওয়ালা ও তার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের কোনো সম্পৃক্ততা এখনো খুঁজে পাননি বলে জানা গেছে। তবে এরপরও তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা ছাড়াও তাদের বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় জব্দকৃত কিছু আলামত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া হবে। এসব আলামতগুলোর নমুনা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিয়ে দেশের বাইরেও পাঠানো হতে পারে। এদিকে শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনা তদন্তে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (স্পেশাল ক্রাইম) জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে কিশোরগঞ্জে এসেছেন। উচ্চপর্যায়ের এই টিমটি আজ শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ছাড়াও মামলার তদন্ত অগ্রগতি ও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করবেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে শোলাকিয়ায় হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামান বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এ সময় তিনি জানান, রিমান্ডে থাকা মামলার আসামি জাহিদুল হক তানিম জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে। তার কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা সম্ভব হয়।

তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, শোলাকিয়া হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করার শেষ ধাপে রয়েছেন তারা। তাদের ধরতে পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তৎপরতা চালাচ্ছেন। যেকোনো সময় এ ব্যাপারে ইতিবাচক খবর পাওয়া যেতে পারে। একটি সূত্র জানায়, ছাত্র পরিচয়ে কিশোরগঞ্জে বাসাভাড়া নেয়া জয়নাল আবেদীন ওরফে আকাশ বর্তমানে গোয়েন্দা জালে রয়েছে। তাকে আটক করা গেলেও শোলাকিয়া হামলার অনেক জট খুলবে বলে জানায় সূত্রটি।

এদিকে শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে আহত শরীফুল ইসলাম এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেনি। র‌্যাবের হেফাজতে সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউনিট ৩-এর ৮নং সার্জারি ওয়ার্ডের ১নং নিউ কেবিনের ১৩নং সিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সুস্থ হওয়ার তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

গত ৭ই জুলাই ঈদের দিন শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় হামলাস্থলের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী পাকুন্দিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে ১০ই জুলাই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় র‌্যাবের হেফাজতে চিকিৎসাধীন দিনাজপুরের শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে সাইফুল ইসলামকে প্রধান ও স্থানীয় জাহিদুল হক তানিমকে দ্বিতীয় আসামি করা হয়।

এছাড়া মামলায় আরও কিছু অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়। প্রধান আসামি শরীফুল গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় র‌্যাবের অভিযানে আটক করা হয়  ঘটনাস্থল চরশোলাকিয়া সবুজবাগ এলাকার মাহাবুবুল আলম ভূঁইয়ার বাসার সেফটি ট্যাংকের ওপর থেকে। আটকের আগে শরীফুল বোমা বিস্ফোরণ ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কয়েক পুলিশকে আহত করার পর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঘটনাস্থলের পাশের একটি বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আটক শরীফুল ও নিহত জঙ্গি আবির রহমানকে পিস্তল, বোমা ও চাপাতি হাতে অ্যাকশনে দেখা যায়।

একপর্যায়ে জঙ্গি আবির পুলিশের গুলিতে নিহত ও শরীফুল বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। এছাড়া মামলার অপর আসামি জাহিদুল হক তানিমকে আটক করা হয় ঘটনাস্থল সংলগ্ন আবদুল হান্নান ভূঞা বাবুলের বাসার আঙিনা থেকে। এ সময় জাহিদুল হক তানিম নিজের রক্তমাখা টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবি বদলে আত্মগোপনের চেষ্টা করছিল। রোববার মামলা দায়েরের দিনই জাহিদুল হক তানিমকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তাকে সপ্তম দিনের মতো বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

গত ৭ই জুলাই ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদগাহের পাশে তল্লাশি চৌকিতে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে জঙ্গিরা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর চাপাতি নিয়ে চড়াও হয়। জঙ্গি এই হামলায় দুই পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপু ও আনসারুল হক নিহত এবং অন্তত ১২ পুলিশ আহত হয়। এ সময় পুলিশ পাল্টা প্রতিরোধ গড়লে হামলাকারী জঙ্গিরা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার এই বন্দুকযুদ্ধের সময় হামলায় অংশ নেয়া আবীর রহমান (২৩) নামে এক জঙ্গি নিহত হয়।

এছাড়া ঘটনাস্থল সবুজবাগ এলাকার ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ ভৌমিকের স্ত্রী ঝর্ণা রাণী ভৌমিক (৪২) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিজ বাসার ভেতরেই প্রাণ হারান। ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল, একটি পরিত্যক্ত অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, দুটি চাপাতি ও দুটি চাইনিজ কুড়ালসহ কিছু কাপড়, গামছা ও টুপি উদ্ধার করা হয়। এদিকে শোলাকিয়াসহ সারাদেশে জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে কিশোরগঞ্জে জঙ্গিবাদ বিরোধী মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও জেলা যুব ইউনিয়নের উদ্যোগে শহরের গৌরাঙ্গবাজারে ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণী পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নেন। মানববন্ধন চলাকালে জঙ্গিবাদ, হত্যা ও সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন জেলা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সাত্তার, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান রুমী, জেলা সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিউল আলম চৌধুরী মিলাদ,

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার বাসিরউদ্দিন ফারুকী, জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব মো. আবদুল আউয়াল, শ্রমিক নেতা বাহাউদ্দিন বাচ্চু, জেলা যুব ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান রিপন প্রমুখ। বক্তারা বলেন, সারা দেশে জঙ্গি হামলাসহ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সবাইকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া এসব কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।-এমজমিন

১৫ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে