আশরাফুল ইসলাম: চেকপোস্টে পুলিশের ওপর জঙ্গিদের হামলার পর পরই প্রতিরোধ গড়েন কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে জনাপাঁচেক পুলিশ সদস্য। সবুজবাগ মোড় এলাকায় জঙ্গিদের থেকে মাত্র ২০ গজের মতো দূরত্বে থেকে তারা সম্মুখযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াই শুরু করেন। এক পর্যায়ে এক জঙ্গির ছোড়া গুলি এসে লাগে ওসি মোশারফের হেলমেটে। এতে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
গুলিতে হেলমেটের সামনের অংশ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এরপরও মনোবল হারাননি তিনি। সাহস নিয়ে সামনে থেকে লড়ে যান জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় জঙ্গি আবীর রহমান। এ সময় অন্য জঙ্গিদের ধরতে শুরু হয় র্যাব-পুলিশের অভিযান। অভিযানের সময় ওসি মোশারফের বুদ্ধিমত্তায় ধরা পড়ে স্থানীয় জঙ্গি জাহিদুল হক তানিম। ঘটনাস্থলের একটি বাসায় অবস্থান নিয়ে জাহিদুল তানিম পোশাক পাল্টে আত্মগোপনের চেষ্টা করে।
কিন্তু চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। বাসার ফ্রিজের পেছনে লুকানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় জাহিদুল হক তানিমের রক্তমাখা টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবি। শোলাকিয়ায় হামলার পর পরই ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের অভিযানের বেশকিছু ভিডিও ও ছবি। এসব ভিডিও ও ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যাতে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন ও ওসি (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামানকে সামনে থেকে অভিযানে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও এলাকাবাসীর মুখে মুখে এখন এই দুই কর্মকর্তার বীরত্বের কাহিনী। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদের দিন সকালে শোলাকিয়া ঈদগাহের ভিআইপি গেটে দায়িত্ব পালন করছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন। ঈদের জামাত শুরু হওয়ার কথা সকাল ১০টায়। কিন্তু সাড়ে আটটার মধ্যেই কানায় কানায় ভরে যায় প্রায় সাত একর আয়তনের ঈদগাহ ময়দান। তখনও শোলাকিয়ার পথে লাখো মুসল্লির স্রোত।
সকাল পৌনে ৯টার দিকে ওয়্যারলেসে বেজে ওঠে সবুজবাগ মোড় এলাকার চেকপোস্টে দায়িত্বপালনকারী পাকুন্দিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুদ্দীনের ‘আমরা আক্রান্ত, বাঁচাও’ আর্তচিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে পাশে থাকা ওসি (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামানকে নিয়ে হামলাস্থলে ছুটেন ওসি মোশারফ। হামলাকারী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেন তীব্র প্রতিরোধ।
এ সময় ওসি মীর মোশারফ হোসেন হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত থাকলেও ওসি (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামান ছিলেন নীল রঙের পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত। শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে জীবনবাজি রেখে লড়েন পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে কোনো হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়াই বন্দুকযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়েন মো. মুর্শেদ জামান।
ওসি মীর মোশারফ হোসেন বলেন, রাইফেল হাতে মসজিদের পাশের একটি বাড়ির পুরনো দেয়ালের আড়াল থেকে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে গুলি করছিলাম। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে আমার হেলমেটে। মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরে গেলো। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। বাম হাত দিয়ে হেলমেট ছুঁয়ে কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কিছুটা ধাতস্থ হয়েই ফের বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়া শুরু করলাম।
একপর্যায়ে আমার বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যায়। তখন মুর্শেদ জামানকে কভার করতে বলি। এ সময় সন্ত্রাসী আবিরের পিস্তলের চেম্বার জ্যাম হয়ে যায়। গুলি করতে না পেরে সে চাপাতি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে। এ সময় মুর্শেদ তার পায়ে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলে আবির লুটিয়ে পড়লে অন্য পুলিশ সদস্যরা তাকে ব্রাশফায়ার করে।
মীর মোশারফ হোসেন জানান, আবির নিহত হওয়ার পর সন্ত্রাসী শরীফুলের পিস্তলের গুলিও শেষ হয়ে যায়। সে গ্রেনেড ফাটিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের গুলিতে সে আহত হওয়ায় ঘটনাস্থলের একটি বাসার সেফটিক ট্যাংকের আড়ালে আত্মগোপন করে। এরই মধ্যে পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় অভিযান চালিয়ে শরীফুলকে আটক করা হয়।
এর আগে আরেক সন্ত্রাসী জাহিদুল হক তানিম পাশের একটি বাসায় আশ্রয় নিয়ে তার গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে পালানোর চেষ্টা করলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, জীবিত অবস্থায় এই দুই সন্ত্রাসীকে আটক করার ঘটনাকে শোলাকিয়া হামলার পর র্যাব-পুলিশের অভিযানের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর সহজেই মেলাতে সহায়তা করছে। আর এই অভিযানে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে সাহসিকতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত জীবনপণ লড়াই করে ওসি মীর মোশারফ হোসেন এবং ওসি (তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামান মানুষের ভালোবাসার পুষ্পবৃষ্টিতে স্নাত হয়ে চলেছেন।-এমজমিন
১৬ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ