মানসুরা হোসাইন : ‘আমি দুই চোখেই দেখতাম। বাপ-মা দুই চোখসহই বিয়া দিছিল। কিন্তু এখন এক চোখে স্বামীর ঘুষা খাইয়া আর কিছু দেহি না। এই চোখে আর দেখমু কি না, তাও জানি না। এখন আমি প্রতিবন্ধী হইয়া গেছি।’—এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন হোসনে আরা আক্তার নয়ন।
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে পাশাপাশি দুটি গ্রাম। এক গ্রামে নয়নের বাড়ি, অন্য গ্রামে স্বামীর ভিটা। বর্তমানে তাঁর ডান চোখ স্বামী মো. আলীর ঘুষিতে ফুলে লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর চোখ থেকে পানি পড়ছে। কালো চশমায় ঢেকে রেখেছেন দুই চোখ। যন্ত্রণায় একবার চশমা খোলেন আবার চোখে লাগান। কিছুক্ষণ কথা বললেই মাথাব্যথা শুরু হয়।
গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে নয়নের সঙ্গে কথা হয়। নয়ন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি স্বামীর উপযুক্ত শাস্তি চান, যাতে আর কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীকে এভাবে মারতে না পারে।
নয়ন মা–বাবার একমাত্র মেয়ে। তাঁর দুই ভাই আছে। বিয়ের সময় রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করা বাবা মেয়ের সুখের জন্য নগদ এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন ছেলেপক্ষকে। সাধ্য অনুযায়ী মেয়ের জন্য গয়নাও বানিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নয়নের বিয়ে হয়। নয়নের ভাষ্য, তিনি বিয়ের পর গত ১০ বছরে এক দিনের জন্যও সুখ পাননি। তাঁর বড় মেয়ে পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে, ছোট মেয়ের বয়স পাঁচ বছর।
নয়ন বলেন, স্বামী পানি চেয়েছে, পানি দিতে একটু দেরি হলেই মার। দুই মেয়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে—সে দোষেও মার খেতে হয়। নয়নের ভাষায়, ‘হুদাই মাইর দেয় স্বামী।’ শুধু স্বামী একা নন, এতে যোগ দেন শাশুড়িসহ অন্যরা। এমনকি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যখন স্বামীর ঘুষিতে নয়নের চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, তখনো অন্যরা ক্ষান্ত হননি। এ ধরনের নির্যাতন এবারই প্রথম নয় বলেও জানান নয়ন।
নয়ন বলেন, স্বামীর সঙ্গে তিনি ঢাকায় থাকতেন। এর আগেও এই ডান চোখেই স্বামীর মারের কারণে অস্ত্রোপচার ও লেন্স লাগাতে হয়েছিল। একবার গরম পানির পাতিলের মধ্যে জোর করে বসিয়ে দিলে কোমরের বড় একটি অংশ পুড়ে যায়। কয়েক বছর ধরে স্বামী ঢাকায় থাকলেও নয়ন দুই মেয়ে নিয়ে গ্রামে বাসা ভাড়া করে থাকছেন।
স্বামী বাসাভাড়া বাবদ মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং সপ্তাহে সংসারে খরচের জন্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে পাঠাতেন। নয়ন কাঁথা সেলাই করে যে টাকা পেতেন, তা দিয়েই মেয়ের পড়া ও সংসারের অন্যান্য খরচ চালাতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে স্বামী বাড়ি যান। দুই মেয়ের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে স্বামী আবার সেই লেন্স লাগানো চোখেই ঘুষি মারেন।
এত দিন নয়ন নির্যাতন সহ্য করে গেছেন। এলাকাবাসী মিলমিশ করিয়ে দিয়েছেন বহুবার। আর মারধর করবেন না—এ মুচলেকা দিয়ে এ পর্যন্ত দুবার স্ট্যাম্পে সই করেছেন স্বামী। ঘুরেফিরে সেই মারধরের ঘটনা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নয়ন দাউদকান্দি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এ অভিযোগ দায়েরে সহায়তা করেন উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিরিন আক্তার।
শিরিন আক্তার জানান, তিনি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দাউদকান্দিতে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। তখন নয়নের ঘটনা শুনে তিনি পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন।
পরে দাউদকান্দি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল আহমেদ ঘটনাস্থলে এসে নয়নকে নিয়ে থানায় যান। এ সময় নয়ন স্বামীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা করার পর ওই রাতেই নয়ন আবার ফোন করে পুলিশকে জানান, মামলা করায় স্বামীর বোন (ননাস) ও তাঁর স্বামী তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন। তখন পুলিশ নয়নের ননাস ও ননাসের স্বামীকে গ্রেপ্তার করে।
আজ দুপুরে প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই স্বামী নয়নকে ফোন দেন। এ সময় স্বামী মামলা তুলে নিতে তাঁকে চাপ দেন। পরে টেলিফোনে নয়নের স্বামী মো. আলী স্ত্রীকে মারধরের কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি ইচ্ছা করে করেননি বলে জানান। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, স্ত্রী স্বামীর ‘জাত’ তুলে কথা বলায় রাগে থাপ্পড় দিতে গেলে চোখে লেগে যায়। এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর কোনো দোষ ছিল না বলেও উল্লেখ করেন মো. আলী।
২৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নয়নকে নিয়ে আসেন। তবে চিকিৎসকের সামনে স্বামী ঘুষি দিয়ে চোখের এ অবস্থা করেছেন, তা বলার সুযোগ পাননি নয়ন। এর আগেও বিভিন্ন নির্যাতনের পর একই অবস্থা হতো। নয়ন স্বামীর বিচার চান, একই সঙ্গে তিনি তাঁর দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তার কথা জানালেন প্রতিবেদককে। --প্রথম আলো
এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস