বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১৬, ০৫:৫৪:৪৬

প্যান্ট পরা পুরুষ দেখলেই পালান ৮ ঘরের নারীরা

প্যান্ট পরা পুরুষ দেখলেই পালান ৮ ঘরের নারীরা

হাসান আল জাভেদ ও নজরুল ইসলাম : ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেঠোপথ। এই পথের উত্তম বাহন তিন চাকার ভ্যানগাড়ি। পুরানো এ পৌরশহর থেকে কিছুদূর এগোতেই চেঁচুয়া বাজারে দেখা গেল শতাধিক ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি। সেখানে বাংলা ভাইয়ের বাড়ি, অর্থাৎ যেখানে সে লুকিয়েছিল, যাওয়ার কথা বলতেই ভ্যানচালকদের অনেকে আগ্রহ দেখালেন। কেউ-কেউ কড়া রোদ সত্ত্বেও ভাড়া চাইলেন একটু কমই। অবশেষে দামদর করে আমরা তিনজন উঠে পড়লাম একটি ভ্যানে। শুরু হলো যাত্রা।

কিন্তু চাইলেই কি আর সহজে যাওয়া যায় বাংলা ভাইয়ের আশ্রয়স্থলে! পথে বটতলা বাজার নামক স্থানে আসতেই কাদায় ভরা রাস্তার কারণে থামতে হলো ভ্যানটিকে। এভাবে থেমে-থেমে অবশেষে পৌঁছানো গেল গন্তব্যস্থান মুক্তাগাছার দুল্লা ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে চান মিয়ার বাড়িতে। এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন জঙ্গি বাংলা ভাই।

ওই বাড়িতে ঢুকতেই বিস্মিত হতে হলো একটি চিত্র দেখে। বিভিন্ন ঘর থেকে বেরিয়ে নারীরা আড়াল হচ্ছেন, এক অর্থে পালাচ্ছেন। চান মিয়ার স্ত্রী রিনা আক্তারও একসময় ‘নেই’ হয়ে গেলেন। এভাবে ওই বসতভিটার আটটি ঘরের সব নারী দ্রুত চোখের আড়াল হলেন।

কারণ কী? জানা গেল, ওই নারীরা এখনো সাদা পোশাকধারী র‌্যাব-পুলিশের ভয়ে থাকেন। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের কাছে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন ষাটোর্ধ্ব নারী অজুফা বেগম। তিনি চান মিয়ার পাশের ঘরের বাসিন্দা। তার বক্তব্য, ‘বাংলা ধরেছেন সেই ১০-১১ বছর আগে। শুনছি এখনো বাংলা ধরা পড়ছে। তাহলে আরও তো বাংলা আছে। তাদের না ধরে, খালি-খালি নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করেন ক্যান।’

এক স্কুলছাত্রীকে পরিচয়পত্র দেখাতেই ওই বাড়ির নারী ও শিশুদের অনেকে এগিয়ে এলেন। তবে আড়ালেই ছিলেন চান মিয়ার স্ত্রী। তারা জানান, মাঝেমধ্যেই সাদা পোশাকে র‌্যাব-পুলিশ আসে। তাই প্যান্ট পরা পুরুষ দেখলেই র‌্যাব-পুলিশের লোক বলে মনে হয় তাদের। তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এক বাংলা ভাইয়ের কারণে এ বাড়ির সবাইকে তটস্থ থাকতে হচ্ছে।

বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়। এরপরই এ দুজনকে মোস্ট ওয়ানটেড ঘোষণা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বলা হয়, তাদের ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সে সময় রাজশাহীর বাঘমারা ছেড়ে রামপুর গ্রামের চান মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেয় বাংলা ভাই। ২০০৬ সালের মার্চে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার হয় জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান।

৬ মার্চ র‌্যাবের একটি দল স্ত্রী ফাহিমাকে নিয়ে এই অজপাড়াগাঁয়ে অপারেশন চালিয়ে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করে। অপারেশনের পর বোমা বিস্ফোরণের কারণে ও স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা চান মিয়ার টিনের ঘরটি পুড়িয়ে দেয়। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় চান মিয়া ও তার স্ত্রী রিনা। কারাবন্দি অবস্থায় তিন মাসের মাথায় রিনা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। পরে তিনি জামিনে মুক্ত পান। কিন্তু জঙ্গি নেতাকে আশ্রয়দান ও জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগে চান মিয়া এখনো কারাবন্দি।

অভিযোগ রয়েছে, শায়খ আবদুর রহমানের জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরে। এদিকে বাংলা ভাই ময়মনসিংহকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেওয়ায় এই অঞ্চলে তাদের অনেক অনুসারী তৈরি হয়। বিভিন্ন সময় ময়মনসিংহে জঙ্গি হামলা, ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনতাই এবং সম্প্রতি নান্দাইলে র‌্যাবের কাছ থেকে শোলাকিয়ায় হামলাকারীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সেই বিষয়টিই স্পষ্ট করে।

স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ময়মনসিংহে যে জেএমবির অনুসারী রয়ে গেছে, সেটা বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনায় স্পষ্ট। তবে হামলা বা হামলার পরিকল্পনাকালে আটক বা গ্রেপ্তার ছাড়া কাউকে জঙ্গি প্রমাণ করাটা দুরূহ। এদিকে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারের পরপর মুক্তাগাছা থেকে গ্রেপ্তারকৃত তার শতাধিক অনুসারী ও সহযোগী কে কোথায় আছে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন বা পুলিশের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

র‌্যাবের অপারেশন প্রসঙ্গে হামিদা আক্তার নামে এক বয়স্ক নারী বলেন, বাংলা ভাই কালা নাকি ধলা (সুন্দর) আমরা এমন কাউকে কখনো দেখিনি। কিন্তু র‌্যাব যখন পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে তখন দেখি এক লোক পেছন দিক থেকে চান মিয়ার ঘরে প্রবেশ করে। এরপর জানতে পারি ওই লোকটাই বাংলা ভাই। যিনি চান মিয়ার ঘরে এতদিন লুকিয়ে থাকতেন। হামিদা আক্তারের মতে, বাড়িতে আটটি ঘর। বাংলা ভাই ধরা পড়ার আগে দু-একজন সৌদি আরবে ছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার পর ভয়ে বাড়ির পাঁচ গৃহকর্তাই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, বাংলা ভাইয়ের আশ্রয় নেওয়া সেই টিনের ঘরটি এখন শূন্য ভিটে। বছরতিনেক হলো ‘অভিশপ্ত’ সেই ভিটায় দুটি আমগাছ ও একটি পেঁপেগাছের চারা রোপণ করেছেন চান মিয়ার স্ত্রী। বসবাসের জন্য ওই ঘর থেকে কয়েক ফুট সামনে আরেকটি টিনের ঘর তৈরি করেছেন তিনি। এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে চান মিয়ার ছোট ছেলে রাকিব নিশ্চুপ ছিল।

প্রতিবেশী হামিদা আক্তার বলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন পর চান মিয়ার স্ত্রী ছাড়া পান। এরপর তিনি চান মিয়ার নামে থাকা চার পাখি আবাদি জমির মধ্যে তিন পাখি বিক্রি করে দেন। ক্রেতাদের সঙ্গে শর্ত চান মিয়া যখন ছাড়া পাবে তখনই জমির দলিল করে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, চান মিয়ার বড় ছেলে রুমান ট্রাক্টরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বড় মেয়ে আরিফার ৫-৬ মাস হলো বিয়ে হয়েছে। আগে চান মিয়ার স্ত্রী অন্যের পাট শুকানোর কাজ করত। মাঝেমাঝে র‌্যাব-পুলিশ এসে খবর নিয়ে যায়। এতে আমরা এখনো ভয়ে-ভয়ে আছি।

পাশের বাড়ির বাসিন্দা ও বটতলা বাজারের দর্জি আসাদ বলেন, গ্রামের পেছনেই বন বিভাগের টিলা-পাহাড়। এলাকার লোকজন পাহাড় কেটে ধানি জমি ও বসতভিটা তৈরি করেছে। এ নিয়ে বন বিভাগের একাধিক মামলায় আসামি নেই গ্রামে এমন লোক খুব কমই আছে। এসব মামলায় পুলিশ মাঝেমধ্যেই আসামি ধরতে আসে। আবার বাংলা ভাইয়ের বাড়ির খবরও নিতে আসে। কিন্তু বন বিভাগের মামলায় মানুষ যতটুকু না ভয় পায়, তার চেয়েও গত ১০ বছর ধরে বেশি ভয় বাংলা ভাই গ্রেপ্তারের ঘটনায়।

দুল্লা ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান হাসেম আলী বলেন, এক বাংলা ভাই এলাকায় জঙ্গি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এখন বাংলা ভাই বা জঙ্গি আছে বলে শুনিনি। যতটুকু জানি, ওই সময় যারা আসামি হয়েছে তাদের সবাই কারাগারে আছে। -আমাদের সময়

১০ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে