ফুলবাড়িয়া: মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, শিক্ষার্থীসহ অসহায় মানুষের বিপদের বন্ধু ছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লীরা তরফদার। কর্মস্থলে অসংখ্য গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দক্ষতা ও সুনামের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। খবরের কাগজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অসহায় মানুষের খবর আসলে সহযোগিতার জন্য ছুটে যান একজন মানবিক ইউএনও লীরা তরফদার।
প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি অনেক সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং নিজের অর্থে অনেকের পাশে থেকেছেন। অনেকে শিক্ষার্থীকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে লেখাপড়া করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিদ্যানন্দ গ্রামে মানসিক দুই প্রতিবন্ধী হাশেম ও তোতা। হাশেম অন্ধকার খুপড়ি ঘরে, তোতা খোলা আকাশের নিচে বেশ কয়েক বছর ধরে দু’জনেই শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছিল। দু’জনেরই দরিদ্র পরিবার অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিল না। ‘বদ্ধ ঘরে হাশেম শিকলবন্দি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সংবাদটি দেখে তিনি ছুটে যান হাশেমের বাড়ি। এ সময় পাশের আরেক শিকলবন্দি তোতার কথাও জানতে পারেন। দু’জনের খোঁজ খবর নেন। তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা নিয়ে তাদের দু’জনকে শিকলমুক্ত করে গত ৪ মাস পূর্বে চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করান।
আবুল হাশেমের ভিক্ষুক পিতা আকতর আলী বলেন, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি, কখনো ভাবিনি সন্তান ভালো হবে। কালের কণ্ঠ পত্রিকার খবর আর স্যারের (ইউএনও) উসিলায় আমার একমাত্র ছেলে আজ ভালো হয়েছে।
পৌর সদরের কাঁচা বাজারে এক বুদ্ধি ও বাক-প্রতিবন্ধী ঘুরে বেড়াত। রাতেও পড়ে থাকাতো এখানে-ওখানে। এই সুযোগ নেয় কোনো এক নরপশু। লালসার শিকার হয়ে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে মেয়েটি। আবু বক্কর সিদ্দিক নামে এক চায়ের দোকানদার মেয়েটিকে চান্দের বাজারে তার বাড়ি নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটি জানতে পেরে লীরা তরফদার ছুটে যান আবু বক্কর সিদ্দিকের বাড়ি। বুদ্ধি ও বাক-প্রতিবন্ধীসহ তার নবজাতকের চিকিৎসাসহ সব দায়িত্ব নেন। মা-মেয়েকে চিকিৎসাসহ সুস্থ করে তোলেন। এর মধ্যে একাধিকবার নিজে গিয়ে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মা-নবজাতককে শিশু খাদ্য নিয়ে দেখে এসেছেন। সুস্থ হলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটি গাজীপুরে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠান আর কন্যা শিশুটিকে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে দত্তক দিয়ে দেন একজন সরকারি কর্মজীবীর কাছে।
আবু সিদ্দিক বলেন, ফুটপাতে চা বিক্রি করে নিজের সংসার চালাতে হিমশিম ক্ষেতে হয়েছে। তারমধ্যে শিশু সন্তানসহ এক মানসিক প্রতিবন্ধী লালন-পালন আমার পক্ষে সম্ভ হয়ে উঠতো না, যদি ইউএনও স্যার সবকিছু দিয়ে সহযোগিতা না করতেন।
শিবগঞ্জ ইউনিয়নের পাটুলি গ্রামে একটি গোয়াল ঘরে গরুর সাথে থাকেন মরিয়ম নেছা নামের শতবর্ষী এক মা। অসুস্থ মরিয়ম নেছাকে খোঁজ খবর নেয় না তার সন্তানেরা। গোয়াল ঘরে শিয়ালে খুবলে খায় অসুস্থ মরিয়ম নেছাকে। ঘটনাটি ২০১৭ সালের পহেলা জুন। ঘটনাটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়। ছুটে যান প্রত্যন্ত গ্রামে সেই বৃদ্ধা মায়ের বাড়ি। গোয়াল ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করে। বৃদ্ধার শরীর নিজের মায়ের মতো করে ঝাপটে ধরেন। তিনি নিজেই মুখে খাবার তুলে দেন অসুস্থ বৃদ্ধাকে। তার এই মানবিকতা দেখে গ্রামের সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স খবর দিয়ে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যায় মচিমহায়। চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নেন তিনি।
ইউএনও লীরা তরফদার বলেন, ছাত্রজীবন থেকে মানব সেবার প্রতি দুর্বলতা ছিল। ২৮তম বিসিএসে প্রশাসিক ক্যাডারে যোগদান করি। প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি করে নিজ দায়িত্ব থেকে মানবসেবা করার আরো বেশি সুযোগ পেয়ে যাই। ভালো কাজ করলে সবাই সহযোগিতা করেন যতটুকু পেরেছি নিজ থেকেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। স্কলারশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য এ মাসে ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি। সাবার কাছে দোয়া চাই। ফিরে এসে যেন আবারও দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।