রাজীব আহাম্মদ: গত চার বছর ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির কার্যক্রম 'দেড়শ গজে বন্দি'। অর্থাৎ দলটির সভা-সমাবেশ ও মিছিল জেলা কার্যালয়কেন্দ্রিক। এখানে বিএনপি কেমন চলছে? এ প্রশ্ন করলে দলটির নেতাকর্মীরাই জবাব দেন, 'পার্টি অফিস থেকে নতুন বাজার মোড়, এই দেড়শ গজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বিএনপির দৌড়।' আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিএনপির কর্মতৎপরতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তারাও একই ধরনের রসিকতা করেন। অবশ্য দেড়শ গজে বন্দি ময়মনসিংহ বিএনপির নেতৃত্ব দুই ধারায় বিভক্ত।
শহরের রাজবাড়ির (মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ) পেছনে দলটির জেলা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা। ভর সন্ধ্যায়ও কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কার্যালয়ের সামনের দোকানদাররা জানালেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আধাপাকা ভবনটি লোকারণ্য থাকত। এখন দলীয় কর্মসূচি না থাকলে কেউ আসেন না। জেলা সভাপতি একেএম মোশাররফ হোসেন সন্ধ্যার পর নিজ অনুসারীদের নিয়ে মোহামেডান ক্লাবে বসেন। সেখান থেকেই দল চলে। জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহাব আকন্দ শহরের বাগানবাড়ি এলাকায় নিজ বাসভবন থেকেই দলের অপর অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। এককালে দু'জনের সুম্পর্ক থাকলেও এখন নেই। তাদের বিরোধে উপজেলা কমিটিগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাও দুই বলয়ে বিভক্ত। ছাত্রদল ও যুবদলেও পড়েছে এর প্রভাব।
টাউন হলের মোড়ে মোহামেডান ক্লাবেই পাওয়া গেল মোশাররফ হোসেনকে। শহর বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলামকেও পাওয়া গেল একই জায়গায়। কথা হলো বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। মোশাররফ হোসেন জানালেন, সারাদেশে বিএনপির যে অবস্থা ময়মনসিংহেও তাই। তবে এ অবস্থার জন্য তিনি দায়ী করলেন আওয়ামী লীগকে। তিনি বললেন, 'কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারি না। পুলিশ আমাদের নতুন বাজার মোড় পার হতে দেয় না। বিএনপি তো সন্ত্রাসী সংগঠন নয় যে, পুলিশের সঙ্গে মারামারি করে শহর দখলে রাখব।'
এমন দুরবস্থায়ও দলে বিভেদ কেন? এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, 'সব দলেই এ ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে।' ওয়াহাব আকন্দ অবশ্য কৌশলী না হয়ে সরাসরি জবাব দিয়ে বললেন, 'সভাপতি বয়সের ভারে নূজ্য। উনি নিজে নিজেকে চিনেন না। অন্যরা উনাকে নিয়ন্ত্রন করে। সভাপতি এখন ডেড হর্স। যারা নিয়ন্ত্রন করে তাদের কারণেই বিরোধ।'
২০০১ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৪ আসনে (সদর) জয়ী হয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন খান দুলু। ময়মনসিংহ-৫ আসনে (মুক্তাগাছা) জয়ী হয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সংস্কারপন্থি হয়ে দল থেকে ছিটকে পড়েন দেলোয়ার হোসেন খান দুলু। ২০০৮ সালে ময়মনসিংহ-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করেন মোশাররফ হোসেন। ময়মনসিংহ-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তার ছোট ভাই জাকির হোসেন বাবলু।
২০১০ সালে জেলা বিএনপির সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হন মোশাররফ হোসেন। অধ্যাপক আবুল কাসেমকে পরাজিত করে সাধারণ সম্পাদক হন প্রভাবশালী আকন্দ পরিবারের ওয়াহাব আকন্দ। তার ভাতিজা যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান আকন্দ (লিটন আকন্দ) বিএনপির শাসনামলে ছিলেন ময়মনসিংহের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের সঙ্গে তার 'ঘনিষ্ঠতা' রয়েছে_ এমন কথাও প্রচলিত ছিল। ময়মনসিংহের বিএনপি তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো। আকন্দ পরিবার রাজনীতিতে শক্তির প্রয়োগ করছে এ অভিযোগের জবাবে ওয়াহাব আকন্দ বলেন, 'শুধু পেশিশক্তির কথা বলছেন কেন, আমাদের তো জনপ্রিয়তাও আছে।'
তবে কাউন্সিলের পর থেকেই অনুসারীদের পদ-পদবি দেওয়া নিয়ে বিবাদে জড়ান মোশাররফ হোসেন ও ওয়াহাব আকন্দ। বিএনপি বিগত সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও তারা দু'জনই ছিলেন জেলা থেকে দলটির সবচেয়ে শক্তিশালী সম্ভাব্য দুই প্রার্থী। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তাদের মধ্যে যে কোনো একজন প্রার্থী হবেন_ এই বিরোধপূর্ণ মানসিকতা জেলা বিএনপিকে এখন থেকেই দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে।
মোশাররফ হোসেন অবশ্য দাবি করেন, দলে মতবিরোধ থাকলেও বিভক্তি নেই। তিনি বলেন, 'একসঙ্গে অনেক লোক থাকলে, একেকজনের একেক মত থাকে। ময়মনসিংহও তার ব্যতিক্রম নয়।' তবে তিনি নিজে কোনো বিরোধ সৃষ্টি করেননি বলে দাবি করে ওয়াহাব আকন্দ বলেন, 'আমি বিরোধ করলে কোনো বিএনপিওয়ালা পরিবার নিয়ে বাড়িতে থাকতে পারত না। বাজার করতে পারত না। '
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি ময়মনসিংহে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও ভোটের মাঠে দলটির অবস্থান বেশ শক্ত। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। ২০১১ সালে পৌর নির্বাচনেও অল্প ব্যবধানে পরাজিত হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। তবে বিএনপি বরাবর দাবি করেছে, ওই নির্বাচনে তারাই জয়ী হয়েছিল। ভোট গণনায় কারসাজি করে ফল বদল করা হয়েছিল। তবে বিএনপির প্রায় সব নেতাই অভিযোগ করেন, পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী শফিকুল ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ওয়াহাব আকন্দ ও তার অনুসারীরা।
এ পুরনো বিবাদ আবার নতুন করে সামনে এসেছে ময়মনসিংহ বিভাগে উন্নীত হওয়ার পর। পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হবে চলতি বছরের শেষদিকে এবং নির্বাচন হবে এমন কথা শোনা যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। মেয়র পদে প্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে জেলা বিএনপিতে বিরোধ আরও বাড়ছে। মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বাধীন অংশ শফিকুল ইসলামকে মেয়র প্রার্থী করতে চান। এর বিরোধিতা করে ওয়াহাব আকন্দ বলেন, 'যদি শফিকুলকে ফেল করাতে পারি, তাহলে কাউকে পাসও করাতে পারব। এবার মেয়র প্রার্থী ওয়াহাব আকন্দ। নির্বাচনে বিএনপির ভোট রক্ষার ক্ষমতা একমাত্র ওয়াহাব আকন্দের আছে। মোশাররফ হোসেনের নেই।' তার ভাতিজা লিকট আকন্দও প্রার্থী।
মোশাররফ হোসেন ও শফিকুল দু'জনই বললেন, কেন্দ্র অনুমতি দিলে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। আর সেই নির্বাচনে দলের তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থীই মেয়র প্রার্থী হবেন। শফিকুল ইসলামের দাবি, তিনিই তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থী। তবে এ দাবির সঙ্গে একমত নন ওয়াহাব আকন্দ। তৃণমূল কাকে বেছে নেয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে বললেন।-সমকাল
৪ মে, ২০১৬/এমটনিউিজ২৪/সবুজ/এসএ