মুন্সিগঞ্জ : থানায় স্বশরীরে হাজির হওয়া মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সেই কলেজছাত্রী নুরুন নাহার ইরাকে আজ বুধবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। জঙ্গি সম্পৃক্ততা নয়, প্রেমের টানেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বিয়ে করেন ইরা। পুলিশের তদন্তে এমনটি প্রমাণ হলেও স্বামীর কাছে ইরাকে ফেরত দেয়নি পুলিশ।
পুলিশ ইরাকে তার বাবা-মার কাছে ফেরত দিতে চাইলেও পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা-মা তাকে ফেরত নিতে চাননি। এ নিয়ে মেয়ের সঙ্গে বাবা-মায়ের অভিমান চলে। কোনো কিছুতেই বাবা-মা মেয়েকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। অবশেষে আজ বুধবার তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিতে মুন্সীগঞ্জের আদালতে পাঠিয়েছে শ্রীনগর থানা পুলিশ।
শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহিদুর রহমান জানান, প্রায় এক মাস আগে ১৯ জুন বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হন শ্রীনগর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী নুরুন্নাহার ইরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইরাকে না পেয়ে গত ১০ জুলাই ইরার মা শামীমা আক্তার মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়ে শ্রীনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, ইরার সঙ্গে তার স্কুলশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম নয়নের প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
তদন্তে জানা যায়, সিরাজুল বর্তমানে ঢাকার গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে অনুরোধ করে সিরাজুলকে মঙ্গলবার শ্রীনগর থানায় হাজির করতে বলা হয়। শিক্ষক সিরাজুল থানায় হাজির হওয়ার আধাঘণ্টা আগে ইরা নিজেই থানায় হাজির হন।
পরিচয় জেনে পুলিশ তাকে নিখোঁজ হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে। জবাবে তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় পুলিশ তাকে আটক করে। কোনো প্রকার জঙ্গি কানেকশন রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতেই পুলিশ তাকে আটক করে।
এর ঠিক আধা ঘণ্টা পরই একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকার গুলশানের আহামেদ গ্রুপের কর্মকর্তা ও ইরার স্কুলের সাবেক শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম নয়ন তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে শ্রীনগর থানায় হাজির হন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মঙ্গলবার মধ্যরাতে স্বীকার করেন ইরা তার স্ত্রী। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে ইরা। পরে ইরার বাবা-মাকে খবর দেয়া হলে তারা মঙ্গলবার রাত থেকে আজ বুধবার সকাল ১১টা পর্যন্ত দফায় দফায় কথা বলে মেয়ের সঙ্গে।
এ নিয়ে মেয়ের সঙ্গে বাবা-মা'র মান অভিমান চলতে থাকে থানাতেই। কিন্তু বাবা-মাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা এ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে নারাজ তারা। তাই মেয়েকে বাড়িতে ফেরত নিতে রাজি হননি তারা।
অগত্যা পুলিশ ঝামেলা এড়াতে ইরাকে তার স্বামীর কাছে ফেরত না দিয়ে আজ বুধবার আদালতে পাঠিয়েছে নিরাপত্তা হেফাজতে নিতে।
জানা যায়, শ্রীনগরে এক মাস ধরে নিখোঁজ কলেজছাত্রী ইরার জঙ্গি কানেকশনের খবরে জেলায় কর্মরত সংবাদকর্মী, প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। কয়েকদিন আগে ওই ছাত্রী তার পরিবারের লোকজনকে ফোনে জানান, তিনি পবিত্র স্থানে রয়েছেন এবং ভালো আছেন।
তাকে খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো তার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সংবাদ পরিবেশন করলে নড়েচড়ে বসে শ্রীনগর থানা পুলিশ।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে ওই ছাত্রী স্বশরীরে শ্রীনগর থানায় হাজির হন এবং কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন এজন্য একটি সাধারণ ডায়েরি করার কথাও বলেন।
পরিচয় পেয়ে পুলিশ তাকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে। এর আগে মঙ্গলবার সকালে নিখোঁজ সরকারি শ্রীনগর কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী নুরুন নাহার ইরার বাবা ইয়াকুব আলী ও মা শামীমা বেগম কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকদের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করে জানান, তাদের মেয়ে বিদেশে জঙ্গি মিশনে যেতেই বাড়ি ছেড়েছে।
ফোন পাওয়ার পর তাদের এ ধারণা আরো জোরালো হয়। নিখোঁজের কিছুদিন আগে ইরা বাড়িতে ধর্মীয় বই আনা শুরু করে এবং হঠাৎ করে বোরখা পরা শুরু করে বলে জানান তার বাবা-মা।
গত ১৯ জুন নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি ইরা। এর ২০ দিন পর গত ১০ জুলাই তার মা শামীমা আক্তার শ্রীনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পর পুলিশ তাদের বাসা থেকে দুটি ধর্মীয় বই উদ্ধার করে। সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি শ্রীনগর সার্কেল) মো. সামসুজ্জামান বাবু জানান, সেগুলো সাধারণ ধর্মীয় বই।
ইরার বাবা জানান, সমষপুর বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি পাস করে ইরা। এরপর শ্রীনগর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কোনো কারণ ছাড়াই মেয়ে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। কলেজে যাওয়ার কথা বলে ওইদিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিল ইরা। এরপর আর ফেরেনি।
মঙ্গলবার ইরার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া একটি ছবির সূত্র ধরে মাঠে নামে পুলিশ। ছবিতে দাড়িওয়ালা এক যুবকের সঙ্গে ইরা ও তার আরো দুই বান্ধবী রয়েছেন।
ওই যুবকের সন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় তার নাম সিরাজুল ইসলাম নয়ন (৩৫)। তিনি পাবনার বর্জনাথপুর গ্রামের আ. হামিদের ছেলে। সিরাজুল ইসলাম বর্তমানে সমষপুর বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ফজলুল হক হান্নুর মালিকানাধীন ঢাকার গুলশান ২ এর ৭২ নম্বর সড়কের ১৫ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত আহামেদ গ্রুপের একজন কর্মকর্তা।
তাকে ২০১৫ সালে ওই স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ওই বছর এএসসি পরীক্ষার আগে তিনি ইরাসহ আরো কয়েকজনের গাইড হিসেবে তিন মাস নিযুক্ত ছিলেন।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে পুলিশ সিরাজুল ইসলামকে শ্রীনগর থানায় হাজির করার জন্য আহমেদ গ্রুপের কর্ণধারকে অনুরোধ করলে সিরাজুল ইসলামকে ওই প্রতিষ্ঠানের একটি গাড়িতে করে তার কয়েকজন সহকর্মীসহ গুলশান থেকে শ্রীনগরে পাঠানো হয়।
সিরাজুল ইসলাম থানায় পৌঁছানোর আধা ঘণ্টা আগে ইরা স্বেচ্ছায় থানায় হাজির হন এবং তার জন্য অন্য কাউকে হয়রানি না করতে বলেন।
বিদ্যালয়ের গাইড থাকাকালে ইরা ও শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরপর সিরাজুল ইসলাম শিক্ষাকতা ছেড়ে দিলেও তারা ফোনে যোগাযোগ রেখে নিয়মিত প্রেমের সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।
একপর্যায়ে বাবা-মাকে না জানিয়ে ইরা বাড়ি থেকে পালিয়ে সিরাজুল ইসলামকে বিয়ে করে গুলশানের একটি বাসায় সংসার শুরু করেন।
নানা জল্পনা-কল্পনা ও পুলিশের দৌড়ঝাঁপের পর অবসান হলো ইরার জঙ্গি সম্পৃক্ততার খবর। অবশ্য মঙ্গলবার সকালে ইরার বাবা ইয়াকুব আলী ও মা শামীমা বেগম কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকদের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তাদের মেয়ে জঙ্গি মিশনে যেতেই বাড়ি ছেড়েছে।
২০জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম