বিল্লাল হোসেন রবিন : শুরু হয়ে গেছে ভোটের হিসাবনিকাশ। ভোটের মাঠে কারা লড়বেন। শুধু মহাজোটের প্রার্থীরা। না বিএনপিও থাকবে। কে পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন। এমন নানা বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সোমবার বিকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র। ওইদিন নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ ২২শে ডিসেম্বর নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করে।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে। নিজ নিজ সমর্থকদের ফোন করে প্রস্তুতি নেয়ার তাগাদা দেন অনেকেই। গতবারের চেয়ে এবারের নির্বাচনে আলাদা একটা আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর তা হলো এবারই প্রথম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয়ভাবে হতে যাচ্ছে। তাই সবার আগে দলীয় সমর্থন আদায়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ঘরানার প্রার্থীরা। মেয়র দলীয় প্রতীকে হলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরাও পিছিয়ে নেই।
তারা দলীয় প্রতীকে সুযোগ না পেলেও দলের সমর্থন আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নানাভাবে স্থানীয় নেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বাদ দিয়ে দলীয় মনোনয়নের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন থাকলে নির্বাচনী মাঠে ‘একটু বাড়তি সুবিধা’ পাওয়া যাবে।
ওদিকে গত সিটি নির্বাচনে ভোটের মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে বিএনপি তাদের দলীয় প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়ার কারণে এবার নিজ উদ্যোগে কোনো প্রার্থী সরব হচ্ছেন না। তারপরও আসন্ন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার, সাবেক এমপি আবুল কালাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইলের নাম এখন পর্যন্ত শোনা গেছে।
এদিকে গতবার লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী বর্তমান মেয়র জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াত আইভী ছাড়াও মেয়র প্রার্থী হিসেবে অনেকদিন ধরেই প্রচারণা চালাচ্ছেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন। যদিও গতবারের নির্বাচনে আনোয়ার হোসেন আইভীর পক্ষে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি শামীম ওসমান শিবিরে। তাই গত নির্বাচনে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী আলোচিত শামীম ওসমান হলেও এবার কে হচ্ছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী তা নিয়ে নানা অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন নগরবাসী।
তবে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানের উপস্থিতিতে গত ২১শে জুলাই নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে আনোয়ার হোসেনকে সমর্থন দেন। সর্বশেষ গত ২৯শে অক্টোবর মহানগর আওয়ামী লীগের সমাবেশেও আনোয়ার হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবার সমর্থন চান। ওই সমাবেশে এমপি শামীম ওসমান বলেন, ‘যদি আনোয়ার হোসেন মনোনয়ন পান তাহলে তার জন্য আমরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবো।’ ওই ঘোষণার আগে থেকেই শামীম ওসমান সরাসরি আনোয়ার হোসেনের পক্ষে কাজ করছেন।
এদিকে সম্প্রতি ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা, উন্নয়নের জন্য ১৯১ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ এবং গত ৯ই অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সহ-সভাপতি করার বিষয়টিকে দলের হাই কমান্ডের “সবুজ সংকেত’ হিসেবে দেখছেন নগরবাসী।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন যেখানে গত বছর ডিসেম্বরে মহানগর কমিটিকে মেয়র আইভীকে সদস্য পর্যন্ত রাখতে দেয়া হয়নি সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করা হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে তাকেই দল নৌকা প্রতীক দেবে।
এদিকে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগকে আগামী ২০শে নভেম্বরের মধ্যে দলীয় প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠানোর নির্দেশ মতো কাজ শুরু করেছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার বিকালে জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউসে বর্ধিত সভার আয়োজন করেছে তারা। সভায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একটি প্যানেল সুপারিশের জন্য তৈরি করা হবে। পরে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক যৌথ স্বাক্ষরে প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলী ও জনপ্রিয়তা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠাবে।
ওদিকে বিএনপির সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও দলের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন তারা। দল নির্বাচনে যাবে কী যাবে না সেটাই এখন পর্যন্ত তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে বিএনপির দলীয় একটি সূত্র জানায়, বিএনপি সব সময় নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক একটি দল। নানা প্রেক্ষাপটে একাধিক জাতীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে বিএনপিকে। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন ইস্যুতে নতুন কৌশলে পথ হাঁটবে বিএনপি। সে উপলব্ধি থেকেই নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে খালি মাঠে কাউকে গোল দিতে না দেয়ার আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হবে। নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন চেয়ারপারসন।
২০১১ সালের মে মাসে সিটি করপোরেশন গঠনের পর ওই বছরের ৩০শে অক্টোবর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে ও বিএনপি তৈমূর আলম খন্দকারকে সমর্থন দেয়। আর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হন ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। তিনি এক লাখেরও বেশি ভোটে শামীম ওসমানকে পরাজিত করে প্রথম নারী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। এবং দেশ ও দেশের বাইরে আলোচনার ঝড় তোলেন। আর ভোটের মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে তৈমূর আলমকে সরিয়ে দেয় বিএনপি। ওই সময়ে তৈমূর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাকে গোসল ছাড়াই কোরবানি দেয়া হয়েছে।’
গত নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন সরাসরি আইভীর পক্ষে কাজ করলেও ২০১৪ সালের জুনে তিনি শামীম ওসমান শিবিরে যোগ দিয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন জেলা কৃষক লীগের সেক্রেটারি রোকন উদ্দিন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি জিএম আরাফাতসহ ১০-১২ জন নেতাকে, যারা একসময় ছিলেন প্রভাবশালী ওসমান পরিবারবিরোধী।
এদিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ বর্তমান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। তিনি বলেন, ‘আপাতত আমি কিছু মন্তব্য করবো না।’ এখনো অনেক কাজ বাকি আছে, কাজ করছি। বাকি কয়টা দিনে যতটুকু শেষ করা যায়। আর নগরবাসী আমার সেই কাজের মূল্যায়ন করবে। এর আগে সিটি করপোরেশনের সবশেষ বাজেট অনুষ্ঠানে আইভী বলেছিলেন, ‘নৌকার মালিক হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সময়মতো তিনিই নৌকার মাঝি ঠিক করবেন।’
তবে জেলা যুবলীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদির বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে আইভীই পাচ্ছেন নৌকা প্রতীক। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আমাদের এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। অচিরেই আমরা আইভীর পক্ষেই মাঠে নামবো।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, দলের তৃণমূল আমাকে সমর্থন দিয়েছে। আমি নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবো, আশা করছি। আমি দলের একজন ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা। নেত্রী অবশ্যই আমাকে মূল্যায়ন করবেন।’
জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার জানান, ‘গত নির্বাচনে বিএনপির এক লাখ ভোট থাকার পরেও কেন আমাকে মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর জানা হয়নি। আমাকে গোসল ছাড়াই কোরবানি দেয়া হয়েছে। তাই এবার আমার নির্বাচনের কোনো ইচ্ছা নাই। তবে সব সিদ্ধান্ত নেবেন দলের চেয়ারপারসন।’
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি আবুল কালাম জানান, ‘দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মেয়র প্রার্থী নির্বাচন করবেন।’
এদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইলের পক্ষে শহরে প্রচুর ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। চলছে তার প্রচারণা। ইসমাইল বলেন, ‘মানুষ পরিবর্তন চায়। আমি পরিবর্তন ও উন্নয়নের মনোবাসনা নিয়েই মেয়র প্রার্থী হবো।’
৩ জনের নাম প্রস্তাব নগর আওয়ামী লীগের: এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে ৩ জনের নাম উঠে এসেছে মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিথ সভায়। ওই তিনজনের নামই চূড়ান্ত করে দলের হাই কমান্ডের কাছে পাঠানো হবে। মঙ্গলবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউস মিলনায়তনে মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভা শেষে মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট খোকন সাহা জানান, মঙ্গলবারের সভায় আনোয়ার হোসেন সভাপতিত্ব করলেও এখন তিনি নির্বাচনী কাজে থাকায় সহ-সভাপতি চন্দন শীলকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চন্দন শীল জানান, সভায় সবার সম্মতিক্রমে একজনের নাম উঠে আসে। তিনি হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। যেহেতু কেন্দ্র থেকে ৩ জনের নাম চাওয়া হয়েছে সেহেতু আনোয়ার হোসেনের পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান ও বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশিদের নামও প্রস্তাব করা হয়েছে।
চন্দন শীল আরো জানান, মহানগরের ২৭টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সেক্রেটারি ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইভীর নাম না থাকা প্রসঙ্গে চন্দন শীল বলেন, সভায় উপস্থিত কোনো একজন নেতাও আইভীর নাম প্রস্তাব না করায় তার নাম দেয়ার সুযোগ নাই।
এর আগে বিকাল ৩টা থেকে সার্কিট হাউস মিলনায়তনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এমপি শামীম ওসমান যিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য তিনিসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। পরে বিকাল ৫টায় ব্রিফিং করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এমজমিন
১৬ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি