মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে : হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (এনসিসি) নির্বাচনের। মেয়র পদে দুই হেভিওয়েট প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সাখাওয়াত হোসেন খানের সামনে দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানোই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ কম নৌকা প্রতীক পাওয়া সেলিনা হায়াৎ আইভীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ মহানগর নেতাদের বৈঠক হলেও আইভীর সঙ্গে দূরত্ব কমেনি। একই অবস্থা সাখাওয়াত হোসেন খানেরও। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে তার দূরত্ব রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মহানগর নেতাদের দুদফা বৈঠক হলেও সাখাওয়াতের পক্ষে এখনো কেউই কার্যত মাঠে নামেননি। নগর বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। পদ-পদবিহীন সাখাওয়াতকে খুবই ‘দুর্বল’ প্রার্থী বলছে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরাও।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ ঘুরে দুই দলের নেতা-কর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রধান দুই দলের প্রার্থীর ভোটে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ ভোটারই শ্রমজীবী। এই ভোট দুই প্রার্থীর জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শ্রমজীবীদের বড় অংশই থাকেন বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। নৌযান, মোটরযান, মোটর মেকানিকসহ বেশ কয়েকটি পেশার শ্রমজীবীরা সেখানে কাজ করেন।
তাই আইভী ও সাখাওয়াতের বাড়তি নজর এ দুই এলাকায়। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান খান জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন। তাদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তাও দিচ্ছেন। তাই শ্রমজীবীরা তাকেই ভোট দেবেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কোন্দল নিরসন হয়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাশে নেই আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। দলের এই বড় অংশ আইভীর পাশে থাকছে না, নাকি আইভীই চাচ্ছেন না এ নিয়ে দোটানায় স্থানীয় নেতারা।
বৃহস্পতিবার দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন না শামীম ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা সভাপতি এম এ রশিদ, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সভাপতি মজিবুর রহমান ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ বাদলসহ অন্য নেতারা।
এ প্রসঙ্গে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জের তৃণমূল আওয়ামী লীগের সবাই আমার সঙ্গে আছেন। আচরণবিধি অনুযায়ী পাঁচজনের বেশি নিয়ে আসা যাবে না। তাই সবাইকে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ। কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বী ছিলেন অগ্রভাবে। এ কারণে স্থানীয় নেতারাও ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। শামীম ওসমান মুঠোফোনে দুদফা বার্তা দিয়েও আইভীর সাড়া পাননি বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। এ সময় ক্ষোভের সঙ্গে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের বলেছেন, গণভবনে ডেকে নিয়ে আমাদের অভিভাবক, জননেত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে নিয়েই দলীয় প্রার্থীকে কাজ করতে বলেছেন। আমি দু-দফা মুঠোফোনে বার্তা পাঠালাম আর উত্তর পেলাম না। তারপরও আপনারা প্রত্যেকেই সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামুন। নৌকার বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরবেন।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের ডেকে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি নারায়ণগঞ্জে ফিরে গিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নিদের্শনা দেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বর্ধিতসভাও ডাকা হয়নি। আগের মতোই আইভী চলছেন দল ও দলের বাইরে তার নিজস্ব বলয় নিয়ে, অন্যদিকে এগিয়ে আসেননি শামীম ওসমানও। দলীয় বিরোধ সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে, পুরনো বিরোধ নিরসন হবে, নাকি আগের মতোই থাকবে—তা পরিষ্কার নয় স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে। তবে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ভেবেছিলাম আমার মেয়ে আইভী আমাকে সঙ্গে নিয়েই মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাবে। আমরা সবাই প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু সে একটিবারের জন্য আমাদের ফোন করেও যেতে বলেনি। নেতা-কর্মীরা এতে কষ্ট পেলেও সবাই নৌকার জয় তথা আওয়ামী লীগের জয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবে।
মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, বৃহস্পতিবার আমরা সকাল থেকে প্রস্তুত ছিলাম নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাব। কিন্তু দুপুরে জানতে পারলাম, আইভী মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে দিয়েছেন এবং তিনি সেখানে বামপন্থি নেতা রফিউর রাব্বীকে নিয়ে গেছেন। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল হাই গিয়েছেন, কিন্তু সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত বাদল সেটা জানেন না। আমরা আসলে ভেবে পাচ্ছি না কি হচ্ছে! তারপরও আমরা দল ও নেত্রীর প্রশ্নে নৌকার জন্য একট্টা আছি, নৌকার বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরব।
সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ সদরের ডিআইটি মাকের্ট এলাকা, জিমখানা, মর্গান গালস স্কুল, পুরাতন কোর্ট কালীবাজার, চাষাড়া গোল চত্বর, চানমারী, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি, পাইনাদী, ধনু হাজী রোড, সানারপাড়, সিমরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পুরনো দ্বন্দ্বই নিরসন হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের দুজন সদস্য জানিয়েছেন, দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মনে করেছিলাম কোন্দল নিরসন হবে; কিন্তু তা হয়নি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানোই হবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ। এখন পর্যন্ত তেমন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেখছি না। এদিকে গতকাল আইভীকে নারায়ণগঞ্জের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় আছেন। জেলা বিএনপি সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকার গতকাল একটি মিলাদ মাহফিলে সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে দেখা করলেও ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। নির্বাচনে না থাকার ঘোষণা দিয়েও তিনি নিজে স্বস্তিবোধ করছেন না বলে জানা গেছে। দলের সম্ভ্যাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি আবুল কালাম ও এ টি এম কামালের মধ্যেও দায়সারা মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে।
নগর বিএনপির এক নেতা জানান, প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর তুলনায় সাখাওয়াত খুবই দুর্বল। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক বেশি। আইন পেশায় ভালো করলেও রাজনীতিতে তিনি তেমন খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাই নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানোই তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির হাইকমান্ড বিশেষ করে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় নামেন, তাহলে ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে। কেন্দ্রকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
গতকাল শহরের ডিআইটি রোডে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান। এ সময় বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকে তার সঙ্গে দেখা যায়নি। পরে অবশ্য বিকালে শহরের মিশনপাড়ায় এক মিলাদ মাহফিলে তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গে তার দেখা হয়। এদিকে ওই জুমার খুতবার আগে মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুল আওয়াল মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান মসজিদে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের কাছে সবাই আসবেন। সবার জন্যই দোয়া করি। তবে আমরা চাই, এমন একজন প্রার্থী বিজয়ী হোক, যিনি জনগণের উন্নয়নে কাজ করবেন।
এ ছাড়া বিকালে শহরের ডিআইটিতে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন সাখাওয়াত হোসেন। এ সময়ও জেলা ও মহানগরের নেতাদের পাশে দেখা যায়নি। অন্যদের মধ্যে সঙ্গে ছিলেন, স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু আল ইউসুফ খান টিপু, ছাত্রদল নেতা শাহেদ আহমেদ, সজীব, আরিফুর রহমান মানিক, জুয়েল আরমান, শাহজাহান ও মৎসজীবী দলের নেতা জিয়াউল হক জিয়া।
এ সময় সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আমিও সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী আমার সঙ্গে কাজ করবেন বলে আমি আশাবাদী। আশা করব, ৫ ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিটি ওয়ার্ড ও থানার নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমে কাজ শুরু করবেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, এখনো তো প্রচারণা সেই অর্থে শুরু হয়নি। ৫ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরই আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হবে। তখন দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে প্রার্থীদের পাশে স্থানীয় সব নেতাই থাকবেন। যিনি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন না, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে হাইকমান্ড। বিডি প্রতিদিন
২৬ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি