সিদ্ধার্থ সিধু : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ফলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নাসিক মেয়র হলেন তিনি।
২৭ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত নাসিকে মোট ভোট কেন্দ্র ১৭৪টি। প্রাথমিক ভাবে ১৭৪টি কেন্দ্রের ফলাফলে বিজয়ী আইভীর নৌকা প্রতিক পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮২৬ ভোট এবং পরাজিত সাখাওয়াতের ধানের শীষ পেয়েছে ৯৬ হাজার ৬৭৪ ভোট। অর্থ্যাৎ ৮০ হাজার ১৫২ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন আইভী।
নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে হওয়ার কারণে আগে থেকেই নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। পুরো নাম সেলিনা হায়াৎ আইভী হলেও নারায়ণগঞ্জের ছেলে–বুড়ো—সবার কাছে তিনি আইভী আপা ও মা হিসেবে পরিচিত। শিশুদের কাছে তিনি ‘আপা’আর বৃদ্ধদের কাছে ‘মা’। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর বিপুল ভোটে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের কোনো মহানগরে তিনিই প্রথম নারী মেয়র।
সেলিনা হায়াৎ–এর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দু-দুবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তারই মেয়ে আইভী ২০০২ সালের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলেন।
২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। আইভী যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। সূর্য ডুবলেই শহর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় বাতি জ্বলে না, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যায়। আছে আরও অনেক সংকট। আইভী যখন দায়িত্ব ছাড়লেন তখন পৌরসভায় জমা ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, আরও ৪০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছিল। সিটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাড়ে তিন বছরে আড়াই শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেলিনা হায়াৎ আইভী ঘুরে বেড়াতেন শহরের বস্তিতে বস্তিতে। একবার মেয়র ঋষিপাড়া বস্তিতে এসেছেন শুনে হঠাৎ যেন ঈদের আনন্দ দেখা গেল। ছোট ছোট গলির ভেতরে মেয়রের পিছু পিছু হাঁটছেন নারী-শিশু-ছেলে-বুড়োরা। তাদেরই একজন আসমা খাতুন। ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন। মেয়রকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে এই বস্তিতে পানির লাইন ছিল না। সব সময় দুর্গন্ধ থাকত। পানি জমে থাকত। লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আইভী আপা আমাদের জন্য সব করেছেন। তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
আসমার কথায় বোঝা গেল কেন আইভী এখানে এতটা জনপ্রিয়। বস্তির নারীদের প্রায় সবাই আইভীকে তার ঘরে নিয়ে যেতে চান। হাঁটতে হাঁটতেই একটি মেয়েকে দেখে থামলেন মেয়র। জানতে চাইলেন তোমার তো এখন স্কুলে থাকার কথা? মেয়েটি তার নাম জানাল মেঘলা। তার বাবা বিদ্যাসাগর এই বস্তিতেই থাকেন। মেয়েটি জানাল, তার বাবা দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আইভী মেয়েটির বাবাকে ফের স্কুলে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন।
লাকি আক্তার নামে এক মেয়ে একটি ঘরে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। মেয়রকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘আপা, আপনি যখন পৌরসভার মেয়র ছিলেন তখন আমি প্রশিক্ষণ নিছিলাম সেলাইয়ের কাজের। এখন ভালো আছি।’ সাজেদা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘আইভী তো মেয়র না, ও আমাদের মা।’ একই কথা বললেন বস্তিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এই বস্তিতে আছি। আইভী আমাদের জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। এখানকার মেয়েরা নানা কাজ শিখছে।’ এলাকাবাসী জানালেন, একই রকমভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে সুইপার কলোনিতেও।
আইভীর তার কর্মময় জীবনে যেন সবাইকে তা–ই দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র সবার প্রিয় আইভী আপা আবার কারো কাছে ‘মা’। সেই আপা ও মাকে এবারো ফেরালো না নারায়ণঞ্জের মানুষ। দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র করে পাঠালো নগরভবনে, বানালেন নগরমাতা।
২২ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস