তানভীর হোসেন, নারায়ণগঞ্জ : বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় একবার দলের সমর্থন নিয়ে এবং আরেকবার সমর্থন ছাড়াই টানা দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলী আহাম্মদ চুনকা, যাকে ‘পৌরপিতা’ উপাধি দেয় নারায়ণগঞ্জবাসী। কিন্তু তৃতীয়বার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি পরাজয়বরণ করেন। তবে সন্তান হিসেবে এ ব্যাপারে সফল হয়েছেন তার মেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী। টানা তৃতীয়বারের মতো ভোটারদের মন জয় করতে পেরেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচন। এখানেও ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করেন আইভী। আর এ জয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হলেন আইভী।
১৯৩৪ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেওভোগের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আলী আহাম্মদ চুনকার জন্ম। তার বাবার নাম ওয়াহেদ আলী, মা গোলেনুর বেগম। ১৯৫২ সালে তিনি মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
আলী আহাম্মদ চুনকা ১৯৬৮ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ মহকুমা থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তরুণ ও যুব সমাজকে সংগঠিত করেন। চুনকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ পাট শ্রমিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নিজ দল আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি আলী আহমদ চুনকা। দলের সমর্থন পান মহিউদ্দিন আহমেদ খোকা। একই দলের খাজা মহিউদ্দিনও প্রার্থী হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলী আহমদ চুনকাই সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী হন।
তিন বছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চুনকার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দেওভোগ এলাকার নাজিমউদ্দিন মাহমুদ। নির্বাচনে চুনকা পরাজিত হন। ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আলী আহাম্মদ চুনকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনের মাত্র ১৭ দিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে তাকে দেশে আনা হয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে তার পক্ষে নারায়ণগঞ্জে জোর প্রচারণা চালান দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও ১৬ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরদারকে পরাজিত করেন তিনি। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০১১ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত একটানা পৌর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় এর প্রথম ভোট। কিন্তু ওই নির্বাচনে অনেক নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমানকে। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাজিমাত ঘটান আইভী। নির্বাচনে ৬ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে শামীম ওসমান (দেওয়াল ঘড়ি) ৭৮ হাজার ৭০৫, সেলিনা হায়াত আইভী (দোয়াত কলম) ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট পান। টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন আইভী।
সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচন হয়ে গেলো ২২ ডিসেম্বর। এ নির্বাচনেও অনেক নাটকীয়তার পর নৌকা প্রতীক পান আইভী। আর ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাখাওয়াত হোসেন খান। অনেক কারণেই নির্বাচনটি ঘিরে সবার কৌতুহল ছিল ব্যাপক। বিএনপির প্রার্থী শুরু থেকেই নিরব বিপ্লব ঘটানোর আশা করছিলেন। আর এই নির্বাচনে আইভী বাবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবেন নাকি নতুন ইতিহাস গড়বেন সেই অনিশ্চয়তাও ছিল।
তবে নানা নাটকীয়তার পর সুষ্ঠু ভোটে বাজিমাত করেন আইভী। নির্বাচনে ১৭৪ কেন্দ্রে সেলিনা হায়াৎ আইভী তার নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। সাখাওয়াত হোসেন খান ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৯৬ হাজার ০৪৪ ভোট। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কোদাল প্রতীকে মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল পেয়েছেন ৬৭৪ ভোট, মিনার প্রতীকে ইসলামী ঐক্যজোটের এজহারুল হক পেয়েছেন ৯১০ ভোট, হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলনের মুফতি মাসুম বিল্লাহ পেয়েছেন ১৩ হাজার ৯১৪ ভোট, হাতঘড়ি প্রতীকের কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস পেয়েছেন ৪৮০ ভোট ও ছাতা প্রতীকে এলডিপির কামাল প্রধান পেয়েছেন ৪৩২ ভোট।
আলী আহাম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় হলেন ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টারমার্কসহ উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৮৫ সালে রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ওডেসা পিরাগোব মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৮৬ সালে আইভী বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওদেসা নগরের পিরাগভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে। ১৯৯২ সালে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্ন সম্পন্ন করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর রাজবাড়ীর কাজী আহসান হায়াৎ এর সঙ্গে বিয়ে হয় ডা. আইভীর। স্বামী কাজী আহসান হায়াৎ বর্তমানে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে নিউজিল্যান্ডে কর্মরত আছেন। পারিবারিক জীবনে তিনি কাজী সাদমান হায়াৎ সীমান্ত ও কাজী সারদিল হায়াৎ অনন্ত নামে দুই ছেলের মা। -বাংলা ট্রিবিউন।
২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম