কাফি কামাল : রূপকথার মতো উত্থান। অবিশ্বাস্য, ভয়ঙ্কর। সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার এক গরিব ঘরের সন্তান নুর হোসেন। পিতা হাজী বদর উদ্দিনের ৬ ছেলের মধ্যে তৃতীয়। দাইমুদ্দিন নামে এক ট্রাকচালকের হাত ধরে আসেন পরিবহন লাইনে। হেলপার হিসেবে সিদ্ধিরগঞ্জের ইকবাল গ্রুপে শুরু করেন কর্মজীবন।
তারপর তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন শিমরাইল শাখার সভাপতি। সাত বছরের মাথায় সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। শিমরাইল ছাড়িয়ে কাঁচপুর থেকে মৌচাক, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আদমজী ইপিজেড পর্যন্ত প্রভাব আর সাম্রাজ্যের বিস্তার। হেলপার থেকে শত কোটি টাকার মালিক। জনপ্রতিনিধি থেকে খুনি। এক আশ্চর্য ভয়ঙ্কর উত্থান।
হেলপার থেকে এক বছর পর একই গ্রুপে ট্রাকচালক হিসেবে পদোন্নতি পান নুর হোসেন। ১৯৮৭ সালে তারই ওস্তাদ দাইমুদ্দিন বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়ন শিমরাইল শাখার কার্যক্রম শুরু করেন। দাইমুদ্দিনকে সরিয়ে নিজেই সে শাখার নেতৃত্ব কব্জা করতে বেশি সময় নেয়নি গুরুমারা বিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠা নুর হোসেন। শিল্পপতি মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে তৎকালীন ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কর্নেল (অব.) অলি আহম্মেদের গাড়িতে বোমা মেরে আলোচনায় এসেছিল নুর হোসেন।
এরশাদের পতনের পর রং বদলে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজ করেন বিএনপির প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে। গিয়াস উদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপি নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামকে (নিহত নজরুল ইসলাম কমিশনারের শ্বশুর) পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। তারপর আর তাকাতে হয়নি পেছনে। তৃণমূল জনপ্রতিনিধি ও পরিবহন শ্রমিক নেতৃত্বের ক্ষমতা এবং সন্ত্রাসকে পুঁজি করে বাড়াতে থাকে অপরাধের সাম্রাজ্য।
শুরুটা ছিল পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি। শিমরাইল ট্রাক টার্মিনাল থেকে প্রতিটি গাড়ির ট্রিপ বাবদ আদায় করতো টাকা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন (বি-৪৯৪)-এর শিমরাইল পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির রসিদে চলতো এ চাঁদাবাজি। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে আদমজীতে বিএনপির জনসভায় যোগ দেয়ার মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ১৯৯৬ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে শিমরাইল মোড়ে তার বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় এক রিকশাচালক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও বিএনপির সমর্থন আদায় করে নুর হোসেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের সমর্থন পান সাত খুনে নিহত নজরুল ইসলাম।
দ্বিতীয়বারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই ভোল পাল্টে শামীম ওসমানের সঙ্গে হাত মেলায় নুর হোসেন। গড়ে তোলে শক্তিশালী আন্ডারওয়ার্ল্ড দল। ১৯৯৭ সালে শিমরাইলের সওজ অফিসে হামলা চালিয়ে দখল করে নির্বাহী প্রকৌশলীর রুম। গুলি করে ও বোমা ফাটিয়ে দখল করে গিয়াস উদ্দিন এমপির কাসসাফ মার্কেটের জায়গা। ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত নুর হোসেনের হাতেই ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের মূল নিয়ন্ত্রণ।
ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে এলাকার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, পরিষদের তহবিল তছরুপ, বন্যার্তদের অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতসহ নানা অনিয়মই ছিল তার নিয়ম। ১৯৯৮ সালের বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পানিতে ডুবে গেলে কাঁচপুর থেকে পূর্বাঞ্চলে লঞ্চ চালিয়ে ও চাঁদাবাজি এবং পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়িপ্রতি আদায় করতো ২০ টাকা করে। ১৯৯৯ সালে ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেট শাখা থেকে উত্তোলন করে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের দুপাশে দৈনিক চাঁদার ভিত্তিতে বসিয়ে দেয় হাজারো হকার। কাউন্সিলর অফিসের পিছনে টোকেন দিয়ে প্রকাশ্যেই বিক্রি করে মাদক।
ট্রাক স্ট্যান্ড ও নিরালয় সিএনজি পাম্পের পাশের একটি দোতলা ভবনে শুরু করে হাউজি, জুয়া ও যাত্রার নামে মাইকিং করে লটারি ব্যবসা। এ নিয়ে মামলাও হয়। সিদ্ধিরগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য গার্মেন্ট, হিরাঝিল ও আশপাশের এলাকার শিল্পকারখানা ও ডেভেলপার কোম্পানি ছিল তার চাঁদাবাজির আরেকটি বড় উৎস। এক ভাই নুর সালামের মাধ্যমে ভূমি জালিয়াতি করে নিরীহদের জমি দখল, উচ্ছেদ ও মধ্যস্থতার নামে শুরু করে চাঁদাবাজি। শিমরাইল আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনালকে পরিণত করে মাদক পরিবহনের নিরাপদ ট্রানজিট পয়েন্ট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে নুর হোসেন নিজেই স্বীকার করেছে, নিজস্ব বাহিনী দিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে প্রতিদিন কোটি টাকা চাঁদা আদায় করতো সে। এ কাজে সে সাড়ে তিনশ লোক নিয়োজিত করেছিল। এদের জনপ্রতি প্রতিদিন পাঁচশ টাকা বেতন ছাড়াও খাবার জন্য খোলা হয়েছিল একটি হোটেল। এভাবে সহজেই সম্পদের পাহাড় গড়ে নুর হোসেন। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিতে চারটি ফ্ল্যাট, শিমরাইলে ১১ শতাংশ জমির ওপর ৫ তলা বাড়ি, ১০ শতাংশ জমির ওপর ৬ তলা ২টি বাড়ি, রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা ভবনসহ ৫টি বিলাসবহুল বাড়ি ও ৪টি ফ্ল্যাটসহ ৫০ বিঘা জমি ও শিমরাইল টেকপাড়ায় মূল বাড়ির পেছনে ৪০ বিঘার মৎস্য খামারের মালিক হয়ে ওঠে একদার ট্রাক হেলপার নুর হোসেন।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতে পালিয়ে যায় নুর হোসেন। খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অবৈধ দখলদারিত্বসহ নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ২৩ মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ভারতে ফেরারি জীবন কাটায় দীর্ঘ সাত বছর। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে ২০০৭ সালের ১২ই মার্চ তার বিরুদ্ধে রেড ওয়ারেন্ট জারি করে ইন্টারপোল। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইতি ঘটে তার ফেরারি জীবনের। ২০০৯ সালের ২০শে জুন সিদ্ধিরগঞ্জে ফেরার কিছু দিনের মধ্যেই চাঁদার দাবিতে দখল করে নেয় শিমরাইল মোড়ের এ রহমান সুপার মার্কেটের সামনের জায়গা।
২০০৯ সালের ৯ই জুলাই কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যার তীরে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে তাদের ধাওয়া দেয় নুর হোসেন ও তার বাহিনী। ২০১০ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলার অপরাধে মামলা করে বিআইডব্লিউটিএ। অভিযোগ আনা হয় নদী তীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলের। তার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১২ সালে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। ২০০০ সালের ১লা অক্টোবর থানা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে যুবলীগ নেতা মতিনকে গুলি করে হত্যা করে নুর হোসেনের বাহিনী।
২০১১ সালে প্রথম নাসিক নির্বাচনে নির্বাচিত হয় ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর শিমরাইল মোড়ে পরিবহন ও ব্যবসা খাতে চাঁদাবাজি, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডারবাজি, সওজ বিভাগের শিমরাইল অফিসে টেন্ডারবাজির নেতৃত্বে ছিল সে। তার ভাই জজ মিয়াকে দিয়ে যুবলীগ নেতা শহীদুল্লাহকে হটিয়ে দখল নেয় কাঁচপুরের পাথর ও বালু ব্যবসা। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে ২০১৩ সালের ২৯শে মে বাগিয়ে নেন সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ। ২০১৩ সালের শেষদিকে বন্দরের মদনপুর এলাকায় একটি হাউজিং কোম্পানির জমি দখলের জন্য অস্ত্রের মহড়া দেয় নুর হোসেন। পরে ওই হাউজিং প্রকল্পে বালু ভরাটের কাজও পায় সে।
হত্যার চার মাস আগে নজরুল ও তার সহযোগীদের সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আদমজী ইপিজেডের ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় নুর হোসেন। সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে থাকতো ১৪টি লাইসেন্সকৃতসহ ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র। মোটা অংকের বিনিময়ে অনেক খুন-গুমের কাজে ভাড়ায় খাটতো নুর হোসেন। গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে খুন হওয়া শামছু চেয়ারম্যানের স্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীর হত্যার পিছনে এক এমপি ও ভাড়াটিয়া ক্যাডার নুর হোসেন দায়ী। যা ওই সময় অধিকাংশ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
২০১৪ সালের ১৯শে মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন, মৃণাল কান্তি দাসের সঙ্গে সুসম্পর্কের জের ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়েও যাতায়াত করতো নুর হোসেন। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে শামীম ওসমানের শিষ্য হিসেবে উত্থান হওয়া নুর হোসেন ক্রমেই ভাঙছিলেন ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ি। শামীম ওসমানের গণ্ডির বাইরে উপরের স্তরেও ছিল তার রাজনৈতিক যোগাযোগ। সেটাই প্রমাণ করে বিগত সরকারের আমলে নূর হোসেনকে প্রশাসক বানানোর জন্য স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বরাবর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের চিঠি। তবে একপর্যায়ে শামীম ওসমানকে এড়িয়ে চলা শুরু করে নুর হোসেন।
১৯৯৭ সালে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্যানেল মেয়র নজরুলের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। নির্বাচনের পর তারা একে অপরকে হত্যার নানা চেষ্টা চালায়। ১৯৯৮ সালে নজরুলের কিলারের গুলিতে আহত হয় নুর হোসেন। ২০০০ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে নজরুলের ওপর নুর হোসেন বাহিনীর হামলায় নিহত হয় মতিন নামে এক যুবক। নুর হোসেন ও নজরুলের বিরোধের শেষ পরিণতি ছিল সাত খুন। ২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল সে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এলিট ফোর্স র্যাব। স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে এক টেলিফোন সংলাপের প্রকাশ হলে তুঙ্গে ওঠে এ আলোচনা।
২০১৪ সালের ১৪ই জুন দুই সহযোগীসহ কলকাতায় গ্রেপ্তার হয় নুর হোসেন। হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে পালিয়েও পার পাননি নুর হোসেন। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১৩ই নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় প্রশাসন তাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এক বিএসএফ ক্যাম্পে জেরার সময় নুর হোসেন নিজেই স্বীকার করে, প্যানেল মেয়র নজরুলকে মারার জন্য র্যাবের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছিল সে। যেখানে তার সহায়ক হয়েছে মেজর আরিফের সঙ্গে নজরুলের সম্পত্তি সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব।
নিজের উত্থান নিয়ে নুর হোসেন বলে, ‘আমি মূলত বাসের হেলপার ছিলাম। অনেক কষ্ট কইরা এই জায়গায় আইছি।’ দীর্ঘদিন প্রাণের ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি এলাকাবাসী। সেভেন মার্ডারে ফেঁসে যাওয়ার পর বেরিয়ে আসে তার অপরাধ জগতের নানা কাহিনী। রাজনীতির ছত্রছায়ায় কথিত বড় ভাইদের আশীর্বাদে সে অপরাধের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এমজমিন
১৭ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি