নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে বর্তমান সময়ের আলোচিত ঘটনা হচ্ছে এক বন্ধুর হাতে নৃশংসভাবে দুই বন্ধু খুন হওয়ার ঘটনা। চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে শহরের সর্বত্র আলোচনার খোরাক এখন এ দুটি হত্যাকাণ্ড। শুধু তাই নয়, এক বন্ধুকে হত্যার পর রক্তমাখা তোষকে ২১ মাস গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুমিয়েছে ঘাতক পিন্টু দেবনাথ। দ্বিতীয় বন্ধুকে খুনের পর রক্তমাখা তোষকে ২১ দিন ঘুমানোর পরই ধরা পড়ে ঘাতক পিন্টু। দুই বন্ধুকে একই কায়দায় হত্যা করলেও লাশ গুম করে ভিন্ন কায়দায়। হত্যার পর নৃশংসভাবে লাশ কেটে ৭ টুকরো করা হয়।
প্রথমে বিষয়টি তদন্তকারী সংস্থা ও নগরবাসীকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। কারণ পিন্টু দেবনাথ ওপেন হার্ট অপারেশনের রোগী। তার পক্ষে একটি মানুষকে হত্যার পর লাশ কেটে ৭ টুকরো করা অসম্ভব। কিন্তু পিন্টুর জবানবন্দির পর সেই সন্দেহ দূর হলেও অবাক হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। পিন্টু স্বীকার করেছে লাশ টুকরো করার আগে সে একটি বিশেষ বেল্ট পরে নিয়েছে। যাতে তার সেলাইয়ের জায়গা ও বুকে চাপ না লাগে। সেই বেল্টও পুলিশ উদ্ধার করেছে। কি ভয়ঙ্কয় কথা! দুই বন্ধু হত্যার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর আঁতকে উঠেছে অন্য বন্ধুরা। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে পিন্টুর পরবর্তী টার্গেট কে ছিল?
পুলিশ, আদালত ও স্থানীয়দের সূত্রমতে, শহরের কালিরবাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে প্রথমে পরিচয় হয় পিন্টু দেবনাথের। পরে প্রবীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রধরে প্রবীরের চার বন্ধু উত্তম সরকার, উত্তম সাহা, গোপী সাহা ও স্বপন কুমার সাহার সঙ্গে পরিচয় হয় পিন্টু দেবনাথের। ঘনিষ্ঠভাবেই তাদের চলাফেরা ছিল। ভারতের কলকাতায় একটি ফ্ল্যাটকে ইস্যু করে পিন্টুর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় স্বপন কুমার সাহার। এক পর্যায়ে পিন্টুর টাকায় কেনা ফ্ল্যাটটি আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা শুরু করে স্বপন কুমার। বিষয়টি টের পেয়ে স্বপনকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় পিন্টু দেবনাথ। এবং পিন্টু বিষয়টি তার গার্লফ্রেন্ড রত্নার সঙ্গে শেয়ার করে। কিন্তু রত্নার সঙ্গে স্বপনের সম্পর্ক ছিল। তারা এক সঙ্গে রাতও কাটিয়েছে। তবে একসময় রত্না পিন্টুর ওপর দুর্বল হয়ে পড়ে। পিন্টু অনেক টাকা খরচ করে রত্নার পেছনে। এক সময় রত্না পিন্টুকে বিশ্বাস করে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখে। পিন্টুর কাছে সে কিছু টাকা লগ্নি করে। পিন্টু ওই টাকার মুনাফাসহ প্রায় ৫ লাখ টাকা রত্নাকে দেয়। রত্না এভাবে প্রায় ১১ লাখ টাকা জমা রাখে পিন্টুর কাছে। এই টাকার জন্য পিন্টু যা বলতো রত্না তা-ই শুনতো। এদিকে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতের একটি চ্যানেলে নিয়মিত ‘ক্রাইম পেট্রোল’ অনুষ্ঠান দেখে পিন্টু ও তার গার্লফ্রেন্ড রত্না রানী চক্রবর্তী। সেই অনুষ্ঠান দেখে হত্যার কলাকৌশল রপ্ত করে পিন্টু। কিন্তু হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে যায় একদফা। তবে দ্বিতীয় দফায় সাকসেস। ২০১৭ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর রত্না রাত কাটানোর অফার দিয়ে বন্ধু স্বপনকে শহরের মাসদাইরে তার ফ্ল্যাটে ডেকে নেয়।
এরআগেই পিন্টু ফ্রুটিকা জুসের তিনটি বোতলের একটিতে ৮টি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়। গল্প-মাস্তির এক পর্যায়ে ট্যাবলেট মিশানো জুস খেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে স্বপন। তারপর শিলনোড়া দিয়ে স্বপনের মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পিন্টু। রক্তে ভিজে যায় তোষক, বিছানার চাদর, বালিশ। পরে স্বপনের লাশ পিন্টু ও রত্না টেনে বাথরুমে নিয়ে যায়। এরপর নতুন ও ধারালো বঁটি দিয়ে স্বপনের দেহ নিখুঁতভাবে একে একে ৭ টুকরো করে পিন্টু। পরে ঘরে থাকা বাজারের ৫টি ব্যাগে ভরে খণ্ডিত অংশগুলো। এবং পিন্টু ও রত্না ব্যাগ তিনটি বাড়ির নিচতলায় নামিয়ে রাখে। ব্যাগের উপরে ঘরে থাকা সবজি দিয়ে দেয় যাতে ব্যাগে লাশের অস্তিত্ব বোঝা না যায়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তিনদফায় লাশভর্তি ব্যাগ তিনটি শহরের সেন্ট্রাল খেয়াঘাটের উত্তরদিকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয় পিন্টু।
মাসদাইর থেকে রিকশায় করে লাশভর্তি ব্যাগগুলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য উপরে দেয়া হয় সবজি। প্রত্যেকবার সে বৈঠা চালানো নৌকা রিজার্ভ করে বন্দরঘাটে যাওয়ার জন্য। পরে মাঝির অগোচরে ব্যাগগুলো ফেলে দেয় শীতলক্ষ্যায়। এরমধ্যে একজন নৌকার মাঝি পিন্টুকে জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যাগে কী? উত্তরে পিন্টু বলেছিল পূজার জিনিসপত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। পূজা তো শেষ তাই নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমা নদীতে ফেলতে হয়। এগুলো ব্যাগের ভেতরে করে এনেছিলাম। স্বপন হত্যার মিশন শেষ করে একেবারেই স্বাভাবিক থাকে পিন্টু। মজার বিষয় হলো-স্বপনের রক্তমাখা তোষকের উপর প্রতিদিন রঙ্গলীলায় মেতে উঠতো পিন্টু ও রত্না রানী। যে তোষকে স্বপনও রত্নার রাতের পার্টনার ছিল। পিন্টুর উপস্থিতি মাঝে মাঝে হলেও রত্না রানী ২১ মাস ওই তোষকের উপরই ঘুমিয়েছে। নিরাপদেই চলছিল বন্ধুর রক্তমাখা তোষকে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে পিন্টুর আমোদ-ফুর্তি। এরমধ্যে পিন্টুর হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। ভারতে গিয়ে সে চিকিৎসা করায়। তার ওপেন হার্ট অপারেশন হয়। পুরো চিকিৎসার সময় পিন্টুর পাশে পাশে ছিল বন্ধু প্রবীর ঘোষ।
এদিকে অর্থ ও বন্ধকী স্বর্ণ আত্মসাৎ, দোকানের পজিশন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় ও পূঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে বন্ধু প্রবীর চন্দ্র সাহাকে হত্যার পরিকল্পনা করে পিন্টু। পরিকল্পনা মতে, চলতি বছরের ১৮ই জুন রাতে প্রবীরকে বিয়ার খাওয়ানোর কথা বলে শহরের আমলাপাড়া কেসিনাগ রোডে পিন্টু তার ভাড়া ফ্ল্যাটে ডেকে নেয় প্রবীরকে। বাসায় যাওয়ার পর প্রবীরকে বিস্কিট ও স্প্রাইট খেতে দেয় পিন্টু। স্প্রাইট খাওয়ার এক পর্যায়ে পেছন থেকে বাজার থেকে কিনে আনা চাপাতি দিয়ে প্রবীরের মাথায় আঘাত করে। রক্তাক্ত প্রবীর বাঁচার জন্য জাপটে ধরে পিন্টুকে। ধস্তাধস্তির মধ্যে পিন্টু চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি পিন্টুকে কোপাতে থাকে। প্রবীর নিস্তেজ হয়ে খাটের উপর লুটিয়ে পড়ে। এরপর প্রবীরের বুকের উপর বসে বালিশ চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
পরে চাপাতি দিয়ে প্রবীরের লাশ ৭ টুকরো করা হয়। বাজার থেকে কিনে আনা সিমেন্টের ৫টি ব্যাগে লাশের টুকরোগুলো ভরে বাসার নিচে সেপটিক ট্যাংকিতে ফেলে দেয়। হত্যা মিশন সাকসেস করার আগে পিন্টু বেল্ট পরে নেয়। যাতে তার সেলাই ও হার্টে কোনো সমস্যা না হয়। হত্যার প্রবীর ঘোষ নিখোঁজ আন্দোলনে ব্যবসায়ী ও প্রবীরের স্বজনদের সঙ্গে মিশে থাকে পিন্টু। যাতে তাকে তারা সন্দেহ না করে। এবং বিষয়টি রত্না রানীর সঙ্গে শেয়ার করার পর রত্না তাকে বলে তুমি স্বাভাবিক থাকো। এতে কেউ বুঝতে পারবে না। ২১ দিন প্রবীর বন্ধুর রক্তমাখা তোষকে একাই ঘুমিয়েছে। আর ভবনের নিচে সেপটিক ট্যাংকিতে বন্ধুর লাশ! কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। প্রবীরের মোবাইল ফোনের সূত্রধরে পিন্টুর কর্মচারী বাপন ভৌমিক আটক হয় ডিবির হাতে। তার তথ্যমতে ৯ই জুলাই আটক হয় পিন্টু। এবং পিন্টুর দেখানো মতে, সেপটিক ট্যাংকির ভেতর থেকে ৯ই জুলাই রাতে উদ্ধার করা হয় প্রবীরের খণ্ডিত লাশ। এবং তার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় প্রবীরের রক্ত মাখা তোষক, বিছানার চাদর ও বালিশ।
এদিকে নিখোঁজের পর পিন্টুর দেখানো মতে সেপটিক ট্যাংকি থেকে প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নতুন করে ডিবির দ্বারস্থ হয় নিখোঁজ স্বপন কুমারের বড় ভাই অজিত কুমার। পরে স্বপনের বিষয়ে তৎপর হয় ডিবি। এবং পিন্টুর সহযোগী বাপনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে পিন্টুর বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য এবং পিন্টুর বান্ধবী রত্না রানী চক্রবর্তীর সন্ধান ও তার মোবাইল নাম্বার দেয়। মোবাইলের কললিস্ট পর্যালোচনা করে ডিবি জানতে পারে নিখোঁজ স্বপনের মোবাইল রত্না রানী ব্যবহার করেছে। পরে ডিবি রত্না রানীকে আটক করে এবং তার তথ্যমতে স্বপনের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
রত্নাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে স্বপন হত্যার ঘটনা আদালতে বর্ণনা করে রত্না। এবং পিন্টুর নাম বলে। মাসদাইর বাজার কাজী বাড়ির প্রবাসী আজহারুল ইসলামের ৪ তলা ভবনের ২য় তলায় স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকতেন রত্না রানী চক্রবর্তী। চার ভাইয়ের নামে ৪টি ভবন নিয়ে কাজীবাড়ি অবস্থিত। মাঝে মধ্যে রত্নাকে বাজার সদাই করতে দেখতেন বাড়ির লোকজন। ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ হিসেবে রত্নাকে সবাই চিনতো। কখনো বাইরের মানুষের সঙ্গে কোনো কথা বা দীর্ঘ সময় আলোচনা করতেন না। তিনিই যে দেহ ব্যবসা করতেন তা এলাকা বা বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারাও টের পেতেন না।
ডিবির একটি সূত্র জানান, ১৮ই জুলাই রাত ৮টায় মাসদাইরে রত্না রানী চক্রবর্তীর ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। তখন রত্না ও পিন্টু মিলে কোথায় কীভাবে স্বপনকে হত্যা করা হয়েছে তার সবকিছু তুলে ধরেন। রত্না দেখায় কীভাবে স্বপনকে বিছানায় নেয়া হয়েছে। কীভাবে জুস পান করিয়ে তাকে অচেতন করে হত্যা করা হয়েছে। অচেতনের পর সেই বিছানার তোষকে ফেলে স্বপনকে হত্যা করা হয়। অথচ এ বিছানাতেই রত্নার সঙ্গে স্বপনের দৈহিক মিলন হতো। একই ঘটনা ঘটতো পিন্টুর সঙ্গেও। তবে স্বপনকে হত্যার পর ওই বিছানা একক বনে যায় পিন্টুর। নিয়মিত সেখানে চলতো রত্নার সঙ্গে রঙ্গলীলা। অথচ হত্যার পর সেই তোষকে লেগে ছিল স্বপনের রক্ত। অভিযানের সময়ে তোষকের মধ্যে কিছুটা রক্ত পাওয়া গেছে।
তখন রত্না জানিয়েছিল রক্ত পুরো মুছে ফেলা হলেও কিছুটা লেগে ছিল। এটা আর মোছা যায়নি। এছাড়া রত্নার রুম থেকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত শিলনোড়া, বঁটি, রক্তমাখা বিছানার চাদরও উদ্ধার করা হয়। ডিবি ইতিমধ্যে ওই আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছে। এদিকে দুই বন্ধুর নৃশংস হত্যার পর পিন্টুর অন্য বন্ধুদের মধ্যে একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানা যায়। বন্ধুরা রীতিমতো আঁতকে উঠেছে। কেউ কেউ হিসাব কষছে পিন্টুর সঙ্গে তাদের কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব ছিল কিনা। পিন্টু যদি ধরা না পড়তো তাহলে হয়তো আরো কেউ লাশ হতো। এমনটাই মনে করছেন কালিরবাজারের ব্যবসায়ী ও নগরবাসী।সূত্র- বিডি প্রতিদিন