পিয়াস সরকার: কিশোর বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিল বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনায় নিহত পলাশ আহমদ। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বোরকা পরে এক প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সে। এ ঘটনায় এলাকার লোকজনের মারধরের মুখে পড়তে হয় তাকে। ঘটনা জানার পর মাদরাসা থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এমন নানা ঘটনার কারণে পলাশ পরিবারের কাছেই ছিলেন এক যন্ত্রণার বিষয়। কারণে অকারণে প্রবাসী বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে সে ব্যবহার করতো নানা কৌশল। চলতো নিজের মতো করে। পরিবারের কারও কথার ধার ধারতো না সে।
এ কারণে বাবা পিয়ার জাহান সরদারের ভাষায় সে ছিল ‘অবাধ্য’ সন্তান।
একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এতোদিন যে যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন এখন তা আর নেই। ছেলে নেই। কিন্তু এখন আছেন ছেলে হারানো কষ্টে। আর যাই হোক নিজের ছেলে তো। এক সময়ে প্রবাসে থাকা পিয়ার জাহান এখন পরিবার চালান ক্ষুদ্র ব্যবসা করে। বাড়ির পাশেই মুদির দোকান আছে তার। গতকাল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার দুধঘাটা গ্রামের বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। ছেলেকে নিয়ে কষ্ট আর আক্ষেপের বিষয় উঠে আসে তার মুখেই। পিয়ার জাহান বলেন, আমি চাইতাম আল্লাহ যেন তাকে ভালো করে দেয়। আর না হলে উঠায় নেয়। পলাশকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে গ্রামের মানুষদের মাঝেও।
স্থানীয় বাজারের চায়ের দোকান থেকে যেকোনো আড্ডার একমাত্র বিষয় পলাশ। সেখানে এক দোকানের টেলিভিশনে তখন চলছিলো সকাল ১০টার সংবাদ। সংবাদের শিরোনামে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার খবর আসতেই আড্ডায় যেন নতুন প্রাণ পায়। সেই চায়ের দোকানে থাকা প্রতিবেশী আফজাল পাটোয়ারী, তমাল মিয়া, আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েকজন জানান, এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব একটা দেখা হতো না তার। কারণ পলাশ বাড়িতে আসতো কয়েক মাস পর কখনো বা বছরান্তে। তবে এলাকার লোকজনের কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। কারো কোনো ক্ষতির চেষ্টা করেনি। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলো। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আদরের সন্তান পলাশ। বাবা দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থাকায় শৈশব-কৈশর কেটেছে শাসন ছাড়াই। বৃদ্ধ কুদ্দস সরদার পলাশকে নাতি সম্বোধন করে বলেন, পলাশ বাইরে কি করেছে জানা নেই। তবে এলাকায় সবাই তাকে নিয়ে ভালো কথাই বলবে। এ ছাড়াও তারা জানান, অনেক দিনপর বাড়ি ফিরলেও দেখা হলে সালামসহ কুশলাদি বিনিময় করতো সে।
পলাশ স্থানীয় মঙ্গলগড় তাহিরপুর আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই মাদরাসার প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, পলাশ লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিলো না। সে খুব ধূর্ত প্রকৃতির ছিলো। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তাকে মাদরাসা থেকে বরখাস্ত পর্যন্ত করেছিলেন। বরখাস্ত হবার কারণ হিসেবে বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন সে এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারপর তার বাড়িতে বোরকা পরিহিত অবস্থায় যায়। আর তখন এলাকাবাসী ধরে ফেলে। সেই সঙ্গে মারধর পর্যন্ত করা হয় তাকে। বরখাস্ত করা হয় মাদরাসা থেকে। পরে পরিবারের অনুরোধে ফের তাকে মাদরাসায় রাখা হয়। সেখান থেকে পলাশ ২০১২ সালে দাখিল পাস করে।
পলাশের আরেকজন শিক্ষক মো. নুরন্নবী বলেন, পলাশ খুব সুন্দর জাতীয় সংগীত গাইতো। তাকে দিয়ে আমরা সবসময় জাতীয় সংগীত গাওয়াতাম। তিনি আরো বলেন, পলাশের বিরুদ্ধে নারী ঘটিত বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যেত। তাছাড়া তার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ছিলো নারী কেন্দ্রিক।
মাদরাসা থেকে বেরিয়ে দেখা হয় পলাশের ছোট মামা মো. রিটন ও চাচাতো বোনের স্বামী মো. সজিবের সঙ্গে। তারাও একই এলাকার বাসিন্দা। সজিব বলেন, মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করে পলাশ ভর্তি হয় সোনারগাঁও সরকারি কলেজে। সেখানে একবছর পড়ার পর চুকিয়ে ফেলে লেখাপড়ার পাঠ। চলে যায় ঢাকায়। বাবা থাকতেন বিদেশে। পলাশ কোথায় থাকতো? কি করতো? কিছু্ই জানতো না তার পরিবার।
তার দুবাই ফেরত মামা মো. রিটন আক্ষেপ করে বলেন, পরিবারটিকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে পলাশ। পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নিতো সে। স্বপ্ন ছিলো গায়ক হবে, সেই সঙ্গে করবে অভিনয়। অপহরণের নাম করেও বেশ কয়েকবার টাকা নেয় পরিবারের কাছ থেকে। এ ছাড়াও নাটক, অ্যালবাম, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোসহ বিদেশ ভ্রমণ এর জন্য নিতো টাকা। মায়ের কাছে করতো আবদার। সেই আবদার পৌঁছে যেত বাবার কাছে।
টাকা না দিলে- না খেয়ে থাকা, মায়ের সঙ্গে কথা না বলা, নিজেকে শেষ করে দেবার হুমকিসহ নানান কৌশলে হাতিয়ে নিতো টাকা। টাকার পরিমাণ ছিলো ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা অব্দি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনয় শিল্পী সিমলা দুবার গিয়েছিল তার বাসায়। প্রথমবার যায় গত বছরের শুরুর দিকে। ছিলেন কয়েক ঘণ্টা মাত্র। সেসময় পরিচয় দেয় তার বান্ধবী। ফের দুমাস পর সিমলা যায় তার বাড়িতে। সেবার রাত ৯টার দিকে যেয়ে ফেরে রাত সাড়ে ১০টায়। তার মামা রিটনের কথা অনুযায়ী, পলাশের বাবা সিমলার কাছে জানতে চান কেন এই অসম বিয়ে? এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি সিমলা। তবে পলাশের কারণে সেই আলোচনা সেখানেই ইতি ঘটে।
অত্র এলাকার ইউপি সদস্য মজিবর রহমান ভুইয়া। তিনি পলাশের বিষয়ে বলেন, তাকে এলাকার লোকজন খুব একটা চিনতো না। সবসময় ঢাকাতেই থাকতো। তবে বাবা-মা’র কথা কখনোই শুনতো না সে। তার বাবা এই পলাশের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। এক কথায় সে পরিবারের কাছে খারাপ হলেও এলাকাবাসীর কাছে রহস্য ছিল।
দুধঘাটা বাজারে পলাশের বাবা পিয়ার জাহানের মুদি দোকান। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে দেশের বাইরে থাকেন। দেশে ফিরেছেন ৬ বছর হলো। বাজারে সব দোকান খোলা থাকলেও দেখা যায়, তার দোকান বন্ধ। ফেরার পর এই দোকানই তার আয়ের বর্তমান উৎস। দোকান পেরিয়ে সামনে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। এরপর পাকা রাস্তা থেকে নেমে একটু দূরে পলাশের বাড়ি। বাড়িতে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। কাদা পানিতে একাকার বাড়িতে যাবার ছোট গলি। গলির শেষ প্রান্তে একটি ছোট পাকা মসজিদ। মসজিদের পেছনেই দুটি বাড়ি পরে পলাশদের পৈতৃক বাড়ি। একতলা পাকা বাড়ি হলেও শেষ হয়নি বাড়ির নির্মাণকাজ। বাড়ির সামনে রাখা ইট। উঠানে কাদা পানিতে একাকার। পলাশের ছোট বোনের নাম জান্নাত।
এখনো স্কুলে যায় না সে। তার বাড়িতে যেতেই ডেকে দিলো তার বাবাকে। তারা তিন বোন। বাকি দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। অবসাদময় চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। চেয়ার পেতে বসতে দিলেন। প্রশ্ন করার আগেই বললেন, একদম কথা শুনতো না। আমার বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় করা টাকাটা সব ধ্বংস করেছে। এখন এই ভিটা-দোকান ও অল্প কিছু জমি ছাড়া আমার কিছু নাই। আমার প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা ধ্বংস করেছে। আমার কষ্টের টাকা দিয়ে আয়েশ করে ঘুরে বেড়ায়। টাকা না দিলে অশান্তি করতো। তাই টাকা দিতাম। এরপর থমকে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, একবার টাকা দিয়ে রাগে বলেছিলাম- এবার বাড়িতে আসলে ভালো হয়ে আসিস। আর না হয় আল্লাহর যেন উঠায় নেয়। এই কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কান্নার শব্দ পাওয়া যায় পাশের ঘর থেকেও। পাশের ঘরে মা কাঁদছে। আবার তিনি বলেন, ছেলে যতই অবাধ্য হোক। ছেলের লাশ কাঁধে নেয়া অনেক কষ্টের।
প্রতিবার যাবার সময় টাকার আবদার করলেও শেষবার তা করেনি। তিনি নিজে থেকেই ১০ হাজার টাকা দেন। এরপর মোবাইলেও একবার কথা হয় ২৩শে ফেব্রুয়ারি। সেদিন পলাশ জানান ২ দিন পর অর্থাৎ ২৫শে ফেব্রুয়ারি তার দুবাই যাবার ফ্লাইট।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমরা জানতাম না বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা। পরের দিন শুনেছি। যখন বাড়িতে অনেক ধরনের মানুষজন আসা শুরু করে।
লাশ নিতে প্রথমে নারাজি প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলে যতই অবাধ্য হোক তাকে দাফন করা আমার দায়িত্ব।
পলাশের পরিবারের লোকজন জানতেন না সিমলার সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা। তবে সিমলা পলাশের প্রথম স্ত্রী নন। এর আগে তিনি আরেকটি বিয়ে করেছিলেন বগুড়ায়। সেখানে আয়ান নামের তিন বছরের এক ছেলে সন্তান আছে। পিয়ার জাহান জানান, শেষ জীবনে নাতিকে সঙ্গে রাখতে চান তিনি।মানবজমিন