রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : ‘তোর বৌ একটা দুশ্চরিত্রা। এক্ষুণি ওর চুল কাটবি। গলায় জুতার মালা পিন্ধাইয়া তালাক দিয়া গেরাম ছাড়া করবি। নইলে তোর গলা কাটমু আমরা। লগে তোর পোলাপানগোও কাইট্টা পুসকুনিত (পুকুরে) ডুবাইয়া রাখমু’। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বখাটেদের কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এভাবেই সন্তানদের সামনে স্ত্রীর চুল কেটে গ্রাম ছাড়া করতে স্বামীকে বাধ্য করা হয়েছে।
এ অবস্থায় পাগলের মতো গত দুদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় কাটছে গৃহবধূর রাত-দিন। অবশেষে সংবাদকর্মীদের সহায়তায় সোমবার বিকালে আইনের আশ্রয় নেন তিনি। উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার ডুলুরদিয়া এলাকায় রোববার সকালে এই বর্বর ঘটনা ঘটে। গৃহবধূ বিলকিস বেগম জানান, তিনি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার মাতিচর গ্রামের আকবর আলীর মেয়ে। ১৫ বছর আগে ডুলুরদিয়া গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে মোক্তার হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের দাম্পত্য জীবনে ৩টি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম নেয়।
রিকশাচালক স্বামী মোক্তারের একার উপার্জনে অভাবের সংসার চালাতে কষ্ট হয় বিধায় তিনি নিজেও একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। এদিকে প্রতিবেশী সিএনজি চালক আমজাদ হোসেনের ছেলে মোমেন মিয়ার সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সূত্রে গত ৫ মাস আগে মোমেন বিপদে পড়ায় ব্যুরো বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ তুলে দেয়। পরে মোমেন কিস্তির টাকা দিতে গড়িমসি শুরু করলে বিলকিস প্রায় সময় মোমেনকে ফোন করা সহ তার বাড়ি এবং ভুলতা সিএনজি স্ট্যান্ডে টাকা আদায়ের জন্য যাতায়াত শুরু করে।
এতে মোমেনের ভাগিনা ও স্থানীয় আইয়ুব খানের ছেলে ওয়াসিমসহ কয়েকজন বখাটে যুবক সন্দেহ করে বিলকিস মোমেনের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত। তারা বিলকিসকে বলে “তুই মোমেনের সঙ্গে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত, আমাদের সঙ্গেও অনৈতিক কাজ করতে হবে”। ব্যাপারটা বিলকিস স্থানীয় কমিশনারের কাছে নালিশ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বখাটেরা। একমাস আগে তারা ‘পতিতার বিচার নামে’ কথিত সালিশি বৈঠক ডেকে সেখানে জোর করে হাজির করায় বিলকিস ও তার পরিবারকে।
পরে প্রকাশ্যে সালিশি বৈঠকে বিলকিসকে জ্বালানি কাঠ দিয়ে পিটিয়ে হাতের আঙুল ও ডান পা ভেঙে দেয়। দীর্ঘ একমাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গত ২০শে এপ্রিল বিলকিস বাড়ি ফিরেন। এদিকে রোববার সকালে কিস্তির টাকার জন্য বিলকিস ভুলতা সিএনজি স্ট্যান্ডে মোমেনের কাছে যায়। বিষয়টি ওয়াসিমের কানে গেলে সে সহ তার প্রধান সহযোগী একই এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে পলাশ এবং আরো ৭/৮ জন বেলা ১১টার দিকে বিলকিসের বাড়িতে হাজির হয়।
এ সময় বখাটেরা বিলকিসের ৪ সন্তান মুক্তা, শুভ, আক্তার এবং শাকিলের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে স্বামী মোক্তারের হাতে কেচি তুলে দেয়। তারা মোক্তারকে বলে “তার বৌ একজন দুশ্চরিত্রা নারী। তুই এখনই তার চুল কেটে গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রামছাড়া করবি। না হলে তোকেসহ তোর ছেলেমেয়েদের গলা কাটবো আমরা”। ভয়ে আর প্রিয় সন্তানদের জীবন রক্ষা করতে স্বামী মোক্তার কাচি দিয়ে কেটে নেয় বৌ-এর চুল। গলায় জুতার মালা পরিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বখাটেদের কথামতো গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে বিলকিসকে।
পরে সোমবার বিকালে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সহায়তায় থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয় নির্যাতিত সেই গৃহবধূ। গৃহবধূ বিলকিস বেগম বলেন, ‘ভাই এই দেশে নিজের ইজ্জত বাঁচাইতে চাওন কি পাপ? আমার ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিছে, আত (হাত) ভাইঙ্গা দিছে তাও এতো কষ্ট লাগে নাই। যদি চুল না কাইট্রা গলাডা কাইট্রা ফালাইতো তাও এত্তো মন্দ লাগতো না। আমি এর বিচার চাই।’
বিলকিসের স্বামী মোক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি কিছু কমুনা। আমার পোলাপানগো লইয়া আমারে বাঁইচ্যা থাকতে দ্যান। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, এটা অবশ্যই একটি বর্বর ন্যক্কারজনক ঘটনা। আমরা এখন আর আদিম যুগে নেই। এই সময় নারীদের উপর এমন মধ্যযুগীয় নির্যাতন হবে ভাবাই যায় না। আমি এখনই আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। দোষীদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে। -এমজমিন
২৬ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস