নোয়াখালী: ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার নোয়াখালী কলেজ থেকে ম্যাথে অনার্স ২য় বর্ষের রেজিস্ট্রিশন করে বাড়ি ফিরছিল সায়মা আফনান তিন্নি (২১) ও তার চাচাতো বোন রিহাম আফছানা চামেলী (২১)। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় মুঠোফোনে চামেলী জানিয়েছিল, বাবা বাড়ি ফিরছি বিশ মিনিটে। কিন্তু বিশ মিনিটে বাড়ি ফেরা হয়নি? বিশ মিনিট গড়িয়েছে, প্রায় ৩ বছরে……।
ওই দিন সিএনজি করে বাড়ি ফেরার পথে বেপরোয়া গতির সিএনজি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাগান বাড়ির সামনে চলন্ত বাসের পিছনে সজোরো ধাক্কা দেয়। সিএনজি ড্রাইভার ড্রাইভিং সীট থেকে লাফদিয়ে, শুধু নিজেকে রক্ষা করে,ছেড়ে দেয় বেপরোয়া গতির সিএনজি। এ সময় রাস্তায় ৩ পাল্টি খায় সিএনজি।
তারপর সে এক করুণ ৩ বছরের তীব্র বেদনার মর্মান্তিক ইতিহাস। সেই দিন দুর্ঘটনায় নোয়াখালী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও সদ্য ১মাস ১৭দিনের নববধূ তিন্নি মারা যায়।
অন্যদিকে, নোয়াখালী কলেজে ম্যাথে অনার্স প্রথম বর্ষে প্রথম হওয়া চামেলীর জীবনকে ঢেকে দেয় নির্মম দুর্ভাগ্য। আজো সেই সব দিনের কথা মনে হলে ভয়ে আঁতকে উঠে চামেলীর পরিবার। শত আর্তনাদ, বুকভরা অবদমিত কান্না নিশ্ছিদ্র ভালোবাসায় চামেলীর পিতা মিজানুর রহমান, মাতা-জিন্নতের নেছা, এ পৃথিবীর এক অন্য রকম পিতা-মাতা।
চামেলীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২ সেপ্টম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় দুর্ঘটনার শিকার হলে, তাকে গুরুত্বর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে, চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুর্ঘটনার পর থেকে প্রথম ১৩ মাস ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) তে ছিল চামেলী। ১৭মাস ছিল অজ্ঞান, ৬মাস ছিল অক্সিজেন এ। এরপর তাকে ২০১৭ সালের ১৭ই মে থেকে ১৩ মাস ঢাকার সিআরপি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে থেরাপির চিকিৎসা করান। এভাবে প্রায় ৩ বছর কেটেছে তাদের পুরো পরিবারের হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে।
একটা সময় ডাক্তার চামেলীর আশা আমাদেরকে ছেড়ে দিতে বলে। এমনকি আইসিইউ থেকে দুইদিন বাহিরে রাখলে চামেলী মারা যাবে, পরিবারও ঝামেলা মুক্ত হবে বলে ইঙ্গিত করে। ডাক্তারের কথা ছিল চামেলী একেবারে কোন ভাবেই বাঁচবেনা। মসজিদের হুজুরের সাথে ডাক্তারের প্রস্তাব নিয়ে পরামর্শ করলে, হুজুর জানান একটি মেয়ের জন্য যদি পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়, পথে বসে যায়, সে ক্ষেত্রে আইসিইউ’র মেশিন খুলে ফেললে গুনাহ্ হবেনা। এরপর ডাক্তার ৪মাসে একবারও চামেলীকে দেখতে আসেননি।
কিন্তু আমরা কারো কথায় কান না দিয়ে আল্লার উপর ভরসা রেখে প্রায় ৩ বছর একাধারে হাসপাতালে ছিলাম চামেলীকে নিয়ে। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে বাড়ি ছেড়ে, ২০১৮ সালের ৩০জুন শুক্রবার রাত ১টা ৩০ মিনিটে বাড়ি ফিরে আসি।
এই দুর্ঘটনায় ডাক্তারদের চিন্তার বাহিরে শুধু মাত্র আল্লার ইশারায় চামেলী অনেক সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু চামেলী বর্তমানে দুই চোখেই একেবারেই দেখতে পায়না। উঠে দাঁড়াতে পারলেও আজো ভালো ভাবে চলাফেরা করতে পারেনা।
এ মেধাবী ছাত্রী চামেলী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে সরকারি বৃত্তি লাভ করে, নতুন বাজার হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এসএসসিতে এ গ্রেড পায়, ২০১২ সালে সরকারি মুজিব কলেজ থেকে এইচএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পায়, সর্বশেষ ২০১৪ সালে নোয়াখালী কলেজ থেকে ম্যাথে অনার্স প্রথম বর্ষে প্রথম হয়।
চামেলীর এক সময় স্বপ্ন ছিল এডুকেশন বিসিএস ক্যাডার হবে। আজ তার পিতা মাতার স্বপ্ন মেয়েটি যদি চোখে আবার আলো ফিরে পায়। নোয়াখালীর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চামেলীর চিকিৎসার জন্য তিন বছরে ৩২ লাখ টাকা দিয়েছে তার পরিবারকে। বাবা এবং মা খুঁইয়েছেন পরিবারের সর্বস্ব। আজ চামেলীর পিতা-মাতার ঘরভিটে ছাড়া তেমন কিছু নেই।