এমটিনিউজ ডেস্ক : সামান্য বেতনে চাকরি করতেন মো. নুরুজ্জামান। যা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। তাই প্রতিবেশীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন দুটি গাভী। তারপর আর নুরুজ্জামানকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার ৩৫টি গাভী ও ৩২টি মহিষের বিশাল খামার রয়েছে।
মো. নুরুজ্জামান নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের চরকৈলাশ গ্রামের আছিউল হকের ছেলে।
জানা যায়, দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্টার রোলে চাকরি করতেন নুরুজ্জামান। এক মাসের বেতন পেতে অপেক্ষা করতে হতো ৬-৭ মাস। এতে করে সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হতো তাকে।
অভাব ঘোচাতে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি নুরুজ্জামানের। শেষে ২০১৬ সালে প্রতিবেশী ও বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দুটি গাভী কেনেন নুরুজ্জামান। তারপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তার। খামারের আয় দিয়েই বিয়ে দিয়েছেন তিন মেয়েকে। বড় করেছেন খামারের পরিধি। বর্তমানে ৮ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার খামারে। স্বাবলম্বী নুরুজ্জামান এখন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অনুপ্রেরণা।
নুরুজ্জামান বলেন, এক সময় একটা ছাগলের বাচ্চা কেনার সামর্থ্যও আমার ছিল না। এখন আমার খামারে ৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমি স্বাবলম্বী হয়েছি এবং হাতিয়া প্রাণি সম্পদে সমৃদ্ধ হচ্ছে। নতুন নতুন খামার হচ্ছে। ফলে অনেকেই বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। স্বাভাবিক সময়ে খামারে ৩০০-৩৫০ লিটার দুধ হয়। আর গরু গর্ভধারণ করলে দুধের পরিমাণও কমে যায়। ৩০০ লিটার দুধ মাসে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারি। এভাবে আমি লাভবান হয়েছি। তিন মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কিছু জমিও কিনেছি। এখন আল্লাহর রহমতে সুখে আছি।
তিনি আরও বলেন, মাস্টার রোলে চাকরি করেছি ৭ বছর। মাস্টার রোলে চাকরির সময় ঠিকমতো বেতন পেতাম না। দৈনিক ১২০ টাকা করে মাসে ৩৬০০ টাকা পেতাম। যা বেতন পেতাম তাও সময়মতো দিতো না। বাবার গরু বিক্রির ব্যবসা ছিল। কয়েকদিন বাবার সঙ্গে গরু ব্যবসায় যুক্ত ছিলাম। পরবর্তীতে সেটা ছেড়ে দিয়ে দোকান দেয়। মুদি দোকান থেকে চা দোকান পরে ভাতের হোটেলও দিয়েছি কিন্তু কোনোভাবেই লাভের দেখা পাইনি। পরে আমার বোন ও এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গরু-ছাগলের ব্যবসায় নামি। হাতিয়া থেকে গরু কিনে সারাদেশে বিক্রি করতাম আবার বিভিন্ন জেলা থেকে গরু কিনে হাতিয়ায় বিক্রি করতাম। তখন শখ করে দুটি দুধের গরু কিনি। সেখান থেকেই আমার ভাগ্য ঘুরে যায়।
নুরুজ্জামান বলেন, দধি বসানো ছাড়া আমাদের হাতিয়ায় দুধ চলে না। গোয়ালকে ৪ দিন দুধ দেওয়ার পর সে আমাকে জানায় গরুর দুধে দই বসে না। দই বসাতে হলে মহিষের দুধ লাগবে। পরে আমি ইন্ডিয়ান ৪টি মহিষ কিনি। গাভী কিনি আরও দুটি। সেই থেকে খামারে গরুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এখন আমার ২০টি গাভী দুধ দিচ্ছে। বাচ্চা ও গর্ভবতীসহ এখন ৩৫টি গাভী আছে। আর ৪টি মহিষের সঙ্গে আরও দুটি মহিষ কিনেছি। বর্তমানে আমার ৩২টি মহিষ আছে। এছাড়া এর মধ্যে ১২-১৪টি মহিষ বিক্রিও করেছি।
শুরুর দিকে গরু লালন-পালন নিয়ে অভিজ্ঞতা ছিল না উল্লেখ করে নুরুজ্জামান বলেন, শুরুর দিকে গরু লালন পালন নিয়ে তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। শখ করে লালন-পালন করেছি। সামান্য অসুখ হলেই সাড়ে তিন লাখ টাকার গরু জবাই করে ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করতে হতো। এতে করে অনেক লোকসান হতো। পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু শিখেছি। আমার হাতেই হাতিয়ায় ৭/৮টি খামার হয়েছে। খাদ্যের দাম বেশি হলেও হাতিয়ায় ঘাস রয়েছে। আমি ঘাস চাষ করি। কাঁচা ঘাসে গাভীর দুধ ভালো হয়।
নুরুজ্জামান আরও বলেন, আমাদের উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা জামরুল স্যার খুব ভালো কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের কিছু সমস্যা আছে। বর্ষা মৌসুমে দুধ বিক্রি হয় না। আম কাঠালের সময়ও দুধ বিক্রি কমে যায়। যদি হাতিয়াতে মিল্ক ভিটার মতো শিল্প কারখানা স্থাপিত হয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়। দিন দিন দুধ উৎপাদন এত পরিমাণ বাড়ছে যে আমাদের হাতিয়ায় কারখানা না হলে আমরা খুব বিপদে পড়ব।
প্রতিবেশী মো. বেলাল হোসেন বলেন, আমি ৫-৭ বছর ধরে নুরুজ্জামানের খামার থেকে নিয়মিত দুধ কিনি। তিনি প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে এই গাভী ও মহিষ লালন-পালন করেন। আমাদের এলাকাসহ পুরো হাতিয়ায় এই খামারের দুধের সুনাম আছে। দুধের মানও খুব ভালো।
হাতিয়া উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. জামরুল ইসলাম বলেন, নুরুজ্জামান জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। তাকে দেখে হাতিয়ায় অনেক খামার গড়ে উঠছে। এটা আমাদের জন্য যেমন ভালো তেমনি দেশের জন্যও ভালো। কেননা যত খামার তত দুধ উৎপাদন এবং আমাদের দুধের ঘাটতি পূরণ হবে। হাতিয়া দ্বীপ উপজেলা হওয়ায় দুধ বাহিরে প্রেরণ করা কঠিন তাই, নতুন একটি প্রকল্প হচ্ছে। যার মাধ্যমে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করে সেটিকে বাজারজাত করা হবে। এতে দুধ নষ্ট হওয়ার বা ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না এবং দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করে খামারিরা স্বাবলম্বী হবে। নতুন নতুন খামারিও আসবে।
হাতিয়া পৌরসভার মেয়র কে এম ওবায়েদ উল্যাহ বিপ্লব বলেন, হাতিয়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় এখানের মানুষ নদী এবং কৃষি নির্ভর। প্রাণি সম্পদে হাতিয়া অনেক সম্ভাবনাময়ী উপজেলা। আমার পৌরসভার বাসিন্দা নুরুজ্জামান জিরো থেকে কোটি টাকার মালিক। সে স্বাবলম্বী হয়েছে দুধ উৎপাদন করে। দেশের অনেক সম্পদশালী আছেন যারা বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। তাদের কাছে বলব হাতিয়ায় আসুন এবং ঘুরে যান। অনেক খামার রয়েছে এখানে। দুধ থেকে বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনের কারখানা করলে আপনারা লাভবান হবেন এবং এখানের মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।-ঢাকা পোস্ট