জিহাদুল কবির : তাই বলে মাথা কেটে ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তাও আবার কয়েক দিন। কে সেই হতভাগা যার মস্তক দেহ থেকে ছিন্ন করা হল। কেন কাটা হল মাথা? দেহের বাকি অংশ কোথায় গেল? কি ছিল তার অপরাধ? কারা করলো এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড? জানতে হলে ঘটনার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে।
দিনটি ছিল অক্টোবরের ৩০ তারিখ। সন্ধ্যার পর খাবার খাচ্ছিল আটি গ্রামের সাইদ। হঠাৎই একটা ফোন কল। সাঈদের বউ কল রিসিভ করল। এরপর সাঈদকে ফোনটা দিতেই সে তড়িঘড়ি করে বাইরে চলে গেল। তারপর কেটে গেল ১ মাস। ফোনটাও বন্ধ। কোনো কুল কিনারা না পেয়ে ০৪/১২/২০১৭ তারিখ সাঁথিয়া থানায় নিখোঁজ হবার জিডি এন্ট্রি করেন সাইদের বাবা মন্তাজ।
আর পাঁচটা সাধারণ ডায়েরির মত এটাও এন্ট্রি হয় একজন এএসআই শওকতের ওপর। তরুণ অফিসার শওকত। জিডি হাতে পেয়েই ঘটনাস্থল অর্থাৎ জিডিকারীর বাড়িতে যান। সাইদের বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। সন্দেহ করার মত কিছুই মেলে না। কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতো সে। ঘরে বউ আছে। দিন আনে দিন খায়।
তবে মাঝে মধ্যে ইয়াবা সেবন করতো বলে শোনা গেলেও স্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। এছাড়া আর কোনো তথ্যই শওকত পেল না। বারবার সে ঘটনাস্থলে যেতে লাগল। কিছুই মিলল না। কেউ কেউ বলল, হয়তো কোনো মেয়েকে নিয়ে ভেগে গেছে। কিন্তু, আশেপাশের পাঁচ গ্রামেও কোনো মেয়ে ভাগার কথাও শোনা গেল না।
জিডির ১০/১২ দিন পর শওকত আমার কাছে আসে। বিষয়গুলি বর্ণনা করে। আমি পুরো বিষয় শোনার পর শওকতের কাছে থাকা সাইদ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে থাকি। এক পর্যায়ে সাইদ ওই দিন কাদের সাথে ফোনে কথা বলেছিল, একে একে তাদের খুঁজে বের করি। এক সময় নিশ্চিত হই যে, সাইদ যার ফোন কলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিল তার নাম রাজীব। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সদ্য কৈশর উত্তীর্ণ রাজীব নিজেও একজন নেশাখোর।
রাজীবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুঁজতে থাকি। কিন্তু সে কোনোভাবেই ভেড়ে না। ইয়াবা কেনার টোপ দিয়ে কৌশলে তাকে আটক করে শওকত। আমার কাছে নিয়ে এলে সে সাইদের ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে বর্ণনা করে। কিন্তু একটু খোঁজ নিতেই জানা যায়, সে সাইদ নিখোঁজের দিন গভীর রাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলেছে।
এরই মাঝে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে, সাইদ নিখোঁজের ১৫/১৬ দিন পর তার ফোন সাময়িক সময়ের জন্য খোলা ছিল যাদের সাথে ওই সময় সাইদের ফোন থেকে কথা হয়েছে তাদের বিষয়ে দ্রুততার সাথে খোঁজ লাগাই। কিন্তু দেখা যায়, তারা সবাই সাইদের নিকটাত্মীয়। তারা মাঝে মাঝেই ওই নাম্বারে ফোন করে দেখতো ফোন খোলা আছে কি না? আমি হতাশ হয়ে যাই।
হঠাৎ আমার চোখে পড়ে সাঈদ নিখোঁজ হবার আগের ব্যবহৃত ফোন সেট আর পরের ফোন সেট আলাদা। আমার মনে এইবার খটকা লাগে। এরপর আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এল.আই.সি. সেকশনের সহায়তা নেই। জানার চেষ্টা করি, পরবর্তী ফোন সেটটি কে নিয়মিত ব্যবহার করে। তাতে পাশের গ্রামের শামীম নামের এক জনের নাম উঠে আসে।
এই বার নতুন উদ্যোমে ধৃত রাজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। আর এর ফাঁকে শওকতকে লাগাই শামীমের পিছনে। খুব দ্রুতই শামীমের ডিটেইল্স আমার কাছে চলে আসে। তখন রাজীবকে পূনরায় প্রথম থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। তাকে শামীমের কথা বলতেই সে ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে আমরা হয়তো কিছু টের পেয়েছি।
তখন সে জানায়, শামীম, সে ও তার সহযোগীরা সাইদকে খুন করে। করমজা গ্রামের খয়ের বাগানের পাশে ইউক্যালিপটাস বাগানে পুঁতে রেখেছে। কথা গুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই সাঁথিয়া থানার পুরো টিমকে নিয়ে গভীর রাতে বাগানে গিয়ে তার দেখানো জায়গা খনন করি।
তবে মাটির নীচে একটি দড়ি, ছেঁড়া গেঞ্জির টুকরা ও জমাট বাঁধা রক্ত ছাড়া কিছুই পাই না। এই সংবাদ পেয়ে মাননীয় পুলিশ সুপার মহোদয় সশরীরে এসে পুরো বিষয় শোনেন এবং আমাদেরকে দিক- নির্দেশনা প্রদান করেন। স্যার আমাকে হতাশ হতে নিষেধ করেন। বলেন তুমি সঠিক পথে আছো। লেগে থাকো নিশ্চয়ই রহস্য সমাধান হবে।
সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু, বুঝতে পারছিলাম না রাজীব কেন সাইদকে হত্যা করবে। এক পর্যায়ে রাজীব বলে মঙ্গল গ্রামের ফখরুল তাকে আড়াই লাখ টাকা দিতে চায়। বিনিময়ে সাইদকে খুন করতে বলে। কিন্তু, কারণটা তখনও স্পষ্ট ছিল না। ওই দিনই ফখরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে জানায় এক অভাবনীয় তথ্য।
তার বর্ণনা মতে- সে গত দুই বৎসর যাবৎ পুরুষত্বহীন। এজন্য তার স্ত্রী পরপুরুষের প্রতি ঝুঁকে যায়। তার স্ত্রী ষড়যন্ত্র করে তাকে জেলে পাঠায়। এরই ফাঁকে সাইদের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলে। জেলে বসেই সে এই খবর পায়। বাড়ি ফিরে সাইদকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। এলাকার উশৃঙ্খল ছেলে রাজীবকে সে কনট্রাক্ট দেয়। রাজীব ৩০ তারিখ রাতে তাকে ফোন করে জানায় সাইদকে শেষ করে ফেলা হয়েছে। সে প্রামাণ চায়। তখন রাজীব ও শামীম সাইদের কাটা মাথা এনে তাকে দেখায়। এর প্রেক্ষিতে সে তাদের প্রাথমিকভাবে ১৯,০০০ টাকা দেয়।
দু’দিন পর তার মনে সন্দেহ হয়, হয়তো কাটা মাথা সাইদের নয়। সে পূনরায় মাথা দেখতে চায়। শামীম ও রাজীব আবার মাথা নিয়ে গেলে অর্ধগলিত মাথা দেখে সে সনাক্ত করতে না পেরে বাকী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যখন এই কথাগুলি হচ্ছিল এরই ফাঁকে সাঁথিয়া থানার ওসি; ইন্সপেক্টর (তদন্ত) সকলের সহায়তায় খুব কৌশলে শামীমকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে আটক করা হয়।
ধৃত শামীমের কাছে সাইদের ব্যবহৃত সিম না পেলেও যে ফোন সেটে সাইদের সিম ব্যবহৃত হয়েছিল তা উদ্ধার হয়। শামীম জানায় ধরা পড়ার আগে সিম ভেঙ্গে নর্দমায় ফেলে দিয়েছে। সেও ইউক্যালিপটাস বাগানে গিয়ে লাশ পুঁতে রাখার স্থান দেখায়। অতিরিক্তভাবে সে দেখায় কোথায় মাথা কেটে এনে পুঁতে রাখা ছিল এবং দ্বিতীয় বার মাথা দেখানোর পর কোথায় মাথাটা ফেলে দিয়েছে।
মাথাটা সে ফেলেছিল ফখরুলের বাড়ির অদূরে কচুরি পানা ভর্তি ডোবার ভিতর। তার দেখানো মতে ডোবায় লোক নামানো হয়। হাজার হাজার উৎসুক জনতার উপস্থিতিতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন সাইদের কাটা মুণ্ডু ডোবার কচুরি পানার ভিতর থেকে উদ্ধার হয়।
এর চেয়ে বেশি কিছু লেখা সম্ভব নয়। সব কথা তদন্তের স্বার্থে বলতেও পারলাম না। বিগত দেড়টা মাস নানা জল্পনা কল্পনা আর হিসেব নিকেশের পর রহস্য ভেদ করতে পেরে ভালো লাগছে। তবে এক এক জন আসামি সনাক্ত করা আর তাদের ধরা যে কত কষ্টসাধ্য, কতটা ব্যয়বহুল তা বলে বোঝাতে পারবোনা। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে, বিলের কাদা ঠেলে বন- বাদাড়, কবরস্থান, মহাসড়ক ভিন্ন জায়গায় ওঁত পেতে থাকা যে কষ্ট, যে করেছে সে জানে।
এখনও অনেক কাজ বাকি। তদন্তের স্বার্থে সবটা প্রকাশ করছি না। তবে, সকলের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজে দয়া করে সহায়তা করুন। সম্মানিত সাংবাদিক ভায়েরা অনেক কিছু জানতে চান, বুঝতে পারি না যে, তথ্য দেবার সময় না এলে তথ্য দিলে আমার পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবে। বাদী পক্ষের চাপ যে, একটা জিডি হলো পুলিশ কিছু করলো না; কিছু অবুঝ নাছোড় বান্দা জানতে চায় তদন্ত কোন দিকে এগুচ্ছে; সব মিলিয়ে আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শুধু এতটুকু বলি, 'আস্থা রাখুন- আমরা অবশ্যই নিরাশ করবো না।'
লেখক : পুলিশ সুপার, পাবনা। (লেখকের ফেসবুক থেকে)
এমটিনিউজ/এসএস