শুক্রবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:২৪:২৬

‘কেউ মরে বিল সেচে কেউ খায় কৈ!’

‘কেউ মরে বিল সেচে কেউ খায় কৈ!’

আবু এন. এম. ওয়াহিদ: ঊনিশ শ’ ষাট দশকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তখন আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি - সম্ভবতঃ প্র ম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আমরা স্কুলঘরের মাঝখানের কামরায় দক্ষিণ দিকে মুখ করে ইটের পায়ার ওপর ভরকরা মেঝে থেকে ছয় কি আট ইঞ্চি উঁচুতে এক তক্তায় বসতাম। আমার ঠিক বাম পাশে একই তক্তায় বসতো সহপাঠী আব্দুল বারী। সেকালে আমরা মাটির স্লেটে অথবা কালো প্রলেপমাখা কাঠের ওপর মাটির পেন্সিল দিয়ে লিখতাম। পরীক্ষা এলে বাঁশের কঞ্চি চোখা করে দোয়াতে ট্যাবলেট-গুলা কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে লিখতাম। সে যুগে গ্রামগঞ্জে ঝরনা কলমের তেমন চল ছিল না। আমাদের হাতে আসার তো প্রশড়বই ওঠে না।

এমনি এক দিন স্কুলে আব্দুল বারীর বুক-পকেটে দেখলাম একটি নতুন কলম। তার বাবা বাইরে কোথাও কোনো এক কারখানায় চাকরি করতেন। ছুটিতে বাড়ি আসার সময় তার জন্য কলমটি এনেছিলেন। ওই কলম দিয়ে কাগজে একটু লেখার জন্য তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করলাম, সে কলমটি আমার চোখের সামনে নেড়েচেড়ে দেখালো, কিন্তু আমাকে ছুঁতেই দিল না। ঘটনার এখানেই
শেষ নয়। সে আরো বলল, ‘ওই কলমের কালি নাকি কোনোদিন শেষ হবে না! নতুন করে কালি ভরার ঝামেলা ছাড়াই আজীবন একইভাবে ওটা দিয়ে লেখা যাবে!’ কচি মনে ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি কোনো μমেই বুঝতে পারলাম না সেটা কেমন করে সম্ভব। অনেক পরে বড় হয়ে বুঝেছিলাম, ওটা ঝরনা কলম ছিল না, ছিল একটি বলপয়েন্ট কলম।
ঘটনাটি নতুন করে আবার মনে পড়ল যুগ যুগ পরে বেশ কিছু দিন এই সেদিন, যেদিন দৈনিক ইত্তেফাকে শাম্স সাঈদের ‘ফিরে দেখাঃ বল পেনের ইতিহাস’


শিরোনামে সম্পাদকীয় পাতায় প্রায় আড়াই শ’ শব্দের ছোট্ট একটি লেখা পড়লাম। সাঈদ লিখেছিলেন, ‘আমেরিকাতে বলপেন আবিস্কার হয়েছে ১৯০৯ সালে এবং ১৯২৮ সাল পর্যন্ত এর কোনো উনড়বয়ন হয়নি। ওই সময় মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের প্রয়োজনে ঝরনা কলমের পরিবর্তে বল পেনের আধুনিক সংস্করণ তৈরি করে।’ লেখাটি পড়ে মনে হল, এটা একেবারেই অসম্পূর্ণ একটি ইতিহাস এবং পরে গুগল সার্চ দিয়ে বলপয়েন্ট কলমের যে ইতিহাস আমি পেলাম, তাতে মনে হল ওতে কিছু তথ্যবিভ্রাটও ছিল। এ বিষয়ে সেদিন আমি আমি যা পেয়েছিলাম তা সংক্ষেপে আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
জন লাউড নামে আমেরিকার এক চামড়া ব্যবসায়ী ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রম বলপয়েন্ট কলমের আদি সংস্করণ তৈরি করে তার প্যাটেন্ট নেন। উদ্দেশ্য কাগজে লিখা নয়, বরং ট্যান করা চামড়া সোজা করে কাটার জন্য লাইন টানা। পরবর্তী ৩০ বছরে খোদ আমেরিকাতেই বলপয়েন্ট কলমের আরো ৩৫০টি ভিনড়ব ভিনড়ব প্যাটেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোটিরই বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়নি।

কারণ ছিল রিফিলের কালি সমস্যা। পাতলা হলে লিক করত, আর ঘন হলে জমে যেত। আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যে কোনো কোনো সময় একই কালিতে দু’টো সমস্যাই দেখা দিত।
লাউডারের মূল প্যাটেন্টের প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৩৫ সালে ল্যাজলো বিরো নামে এক হাঙ্গেরিয়ান ক্যামিস্ট ও তাঁর ভাই জর্জ বিরোর হাতে বলপয়েন্ট কলমের আধুনিক সংস্করণ আবিস্কৃত হয়। বিরো এক সময় একটি সংবাদ পত্র অথবা ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদক হিসাবে তাঁকে নিউজপ্রিন্ট কাগজে অনেক লেখালেখি করতে হত। ঝরনা কলমে ঘন ঘন কালি ভরতে গিয়ে তিনি বিরক্ত হয়ে পড়েন। তার চেয়ে বড় সমস্যা ছিল ঝরনা কলমের ধারাল নিবের খোঁচায় নিউজ প্রিন্ট কাগজ অহরহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে যেত। এই বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করে ল্যাজলো এবং জর্জ


যৌথভাবে ঘন কালি এবং কলমের মুখে ‘রোলিং বল’-এর ডিজাইন আবিস্কার করেন। কিছুদিন পর বিরো ভ্রাতৃদ্বয় ছুটি কাটাতে যান সাগর তীরে। সেখানে দৈবপাকে তাঁদের সাথে দেখা হয়ে যায় সফররত তৎকালিন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট অগাস্টিন জাস্টোর সাথে। কথায় কথায় তাঁরা প্রেসিডেন্ট জাস্টোকে তাঁদের নতুন কলমের মডেল দেখান। জাস্টো বিরো ভাইদের আবিষ্কারে অভিভূত হয়ে বলেন, ‘তোমরা আর্জেন্টিনাতে এসে এর উৎপাদন শুরু কর!’ কয়েক বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তারপর বিরোরা আর্জেন্টিনাতে চলে গেলেন। যাওয়ার পথে প্যারিসে থেমে তাঁরা তাঁদের আবিস্কৃত ডিজাইনের প্যাটেন্ট নিয়ে যান। কারো কারো মতে, বিরো ভ্রাতৃদ্বয় ১৯৩৮ সালের ১৫ই জুন ব্রিটিশ সরকার থেকে এই প্যাটেন্ট নেন। প্যাটেন্ট যেখানেই করা হউক না কেন, ১৯৪৩ সালে স্থানীয় বিনিয়োগকারির সহায়তায়, তাঁরা তাঁদের প্র ম কলমের উৎপাদন শুরু করেন আর্জেন্টিনায়, কিন্তু এবারও বলপয়েন্ট কলম সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ কলমের মুখের রোলিং বলের ডিজাইন ডিফেক্ট-এর কারণে ৯০ ডিগ্রী কোণে খাড়া করে না ধরলে কালি বের হচ্ছিল না। আবার কোনো কোনো সময় অতিরিক্ত কালি বেরিয়ে আসছিল। বিরো ভ্রাতৃদ্বয় নিরাশ হলেও হতাশ হলেন না। আবার ল্যাবে ফিরে গেলেন। রোলিং বলে গ্র্যাভিটি নির্ভরতার পরিবর্তে ‘ক্যাপিরস্রি অ্যাকশন’ চালু করলেন। বলকে নতুনভাবে ডিজাইন করলেন যাতে একটি ‘ম্যাটেল স্পঞ্জ’-এর মত কাজ করে এবং অতিরিক্ত কালি ঝরা বন্ধ হয়।

বিরো ভ্রাতৃদ্বয়ের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে উনড়বত কলম উৎপাদিত হল, কাজ করল, বাজারে বিক্রিও হল, কিন্তু যেভাবে জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিল তা হল না।
ইত্যবসরে বিনিয়োগকারিদের মূলধন ফুরিয়ে গেল। বলপয়েন্ট কলমের নতুন পূণর্যাত্রা আবার থমকে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আর্জেন্টিনাতে কর্তব্যরত আমেরিকান এয়ার ফোর্সের লোকদের নজরে এল বলপয়েন্ট কলম। ওই কলম


দেখে তাঁরা সাথে সাথে ভাবলেন, প্লেনে উড্ডয়নকালে বলপয়েন্ট কলমের উপযোগিতা ঝরনা কলমের চেয়ে অনেক ভাল এবং বেশি হবে। আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় ঘন ঘন কালি ভরার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এবং কালির অভারফ্লো সমস্যারও সমাধান হয়ে যেতে পারে। তাঁদের মাধ্যমে খবর পেয়ে মার্কিন ফেডারেল সরকার অনেকগুলো কলম কোম্পানির কাছে বলপয়েন্ট কলম উৎপাদনের জন্য বিরো ভ্রতৃদ্বয়ের ডিজাইন পাঠাল। তার মধ্যে ‘এবাহার্ড ফেবার’ নামে এক আমেরিকান কোম্পানি বিরোদের কাছ থেকে ৫ লক্ষ ডলার দিয়ে বলপয়েন্ট কলমের প্যাটেন্ট রাইট কিনে নিয়ে আরেকটু উনড়বত করে তৈরি করার চিন্তা ভাবনা করছে। এমন সময় ‘মিল্টন রেনোল্ডস’্ নামে শিকাগোর এক সেলস্ম্যান আর্জেন্টিনা থেকে বিরো মডেলের কলম এনে সমান্য মাজা ঘসা করে প্যাটেন্ট রাইটের তোয়াক্কা না করে দেদারসে বলপয়েন্ট কলম বানিয়ে বাজারজাত করতে শুরু করেন। রেনোল্ডসের ব্যবসা যখন জমজমাট, তখন এক পর্যায়ে তাঁর অস্থায়ী কারখানায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করত। মার্কেটিংএর জন্য রেনোল্ডস্, ‘গিম্বলস্ রিটেল স্টোর’- এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। বিরো ভ্রাতদ্বয় আবিস্কার করলেও বলপয়েন্ট কলম রেনোল্ডস্ এবং গিম্বলস্ রিটেল স্টোরের মাধ্যমে আমেরিকা তথা বিশ্বের বাজারে সর্বপ্রম ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরের কোনো এক সকালে নিউ ইয়র্কের গিম্বলস্ ডিপার্টমেন্ট স্টোরে একসাথে ৫ হাজার কাস্টমার ভীড় জমায় রেনোল্ডস বলপয়েন্ট কলম কিনার জন্য। ওই সময় প্র মবারের মত এক দোকানে এক দিনে ১০ হাজার ‘বল পেন’ বিμি হয়েছিল। সেদিন প্রতিটি কলমের দাম ছিল সাড়ে বারো ডলার করে। ১৯৪৫ সালের সাড়ে বারো ডলারের বর্তমান মূল্যমান কত হতে পারে আপনারা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। চল্লিশ দশকের
মাঝামাঝি রেনোল্ডস্ লক্ষ লক্ষ বিরো বলপয়েন্ট কলম বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার কামাই করে। আবিস্কার করল হাঙ্গেরীর বিরো ভ্রাতৃদ্বয় আর মজা লুটল


শিকাগোর মিল্টন রেনোল্ডস্। ‘কেউ মরে বিল সেচে কেউ খায় কৈ’। একেই বলে পুঁজিবাদ!
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে