সবুজ আলম ফিরোজ: এখন যত স্মৃতি এসে নাড়া দেয় তার মধ্যে ছোটবেলার স্মৃতি অন্যতম। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলো ছোটবেলার। আমরা দুই ভাই এক বোন। আব্বু থাকে বিদেশে মায়ের আদর স্নেহে বড় হয়েছি। খুব মনে পড়ে এখনো বৃষ্টির দিনে গ্রামে সবুজ মাঠে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে যেতাম। খেলায় সহপাঠিদের সাথে ধাক্কায় কিছুটা আহত হয়ে বাসায় ফিরে আসতাম।
মায়ের শাষনের কোন ঘাটতি ছিলনা। নানান ধরনের বকুনি আর সলার মুঠোর আঘাতে চিৎকার করে কাঁদতাম। তখন দাদি এসে আমাকে মায়ের শাষন থেকে রক্ষা করতো। অবশ্যক এখন দাদি নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে সেই ২০১৩ সালে। দাদি ছিলেন পরিবারে প্রধান। আমার আব্বু এবং বড় জেঠা এই দুই পরিবার মিলেই একটি সংসার। সেই সংসারের কর্তা ছিলেন আমার দাদি। বৃদ্ধ বয়সে খুব কঠোর এবং সুশৃঙ্গলার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করতেন পরিবারকে।
মায়ের কঠোর শাষনের সাথে ভালোবাসারও কোন ঘাটতি ছিল। মনে হচ্ছে যৌথ পরিবারে তখন অনেক ভালো ছিলাম। স্বস্তি পেয়েছিলাম। তাই সেই সময়ে ফিরে যেতে বার বার উদাসিন মন পাগল হচ্ছে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব?
এখন তো যৌথ পরিবার খুব একটা চোখে পড়ে না। দেখা যাচ্ছে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে একক পরিবারের মাঝেই এখন স্বস্তি খুঁজছে, স্বাধীনতা খুঁজছে মানুষ। কিন্তু মানুষ সত্যিই কি একক পরিবারে স্বস্তি, স্বাধীনতার খোঁজ পেয়েছে?
এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই মুশকিল। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়, “মায়ের হাতে সন্তান খুন” “ছেলের হাতে মা খুন” “পরকীয়ার জের ধরে সন্তানদের খুন” সংবাদপত্রের এগুলো প্রতিদিনের শিরোনাম। যান্ত্রিক জীবন ও মানসিক সংকটে অস্থির মানুষের কথাই তুলে ধরছে সংবাদপত্র।
সম্পর্কের বন্ধন দ্বিখন্ডিত হয়ে ভোগী হয়ে উঠেছে মানুষ। সেখানে সন্তানকেও হত্যা করতে হিসেব কষাকষিও করছেনা সেই স্বার্থপর মায়ের মন। সবচেয়ে বিশ্বাস, সবচেয়ে নির্ভারতার সম্পর্কগুলো যেন আজ অপরিচিত আদল নিয়ে সামনে দাঁড়াচ্ছে।
ভেঙ্গে যাচ্ছে যৌথ পরিবারগুলো এটা এখন সবারই জানা। সবাই এটা মেনেও নিয়েছেন। ছেলেরা নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা করতে পারলে, বিয়ে করে আলাদা সংসার করবে। পরিবারের মাঝে সম্পর্ক সুস্থ রাখতে এবং সুখি থাকার জন্য এই কাঠামো সবাই মানছে। বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত এই পরিবর্তন।
আবার যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যারা একক পরিবারে রুপান্তরিত হয়েছেন, তারা কয়েক বছর পরে আবার উপলব্ধি করতে পেরেছেন যৌথ পরিবারের সুবিধা। বিশেষ করে,শিশুদের মানসিক বিকাশে মুল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য এক ছাদের নিচে বসবাস করা প্রয়োজন অনেকেই পরবর্তী উপলব্ধি করেছেন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা এবং এর থেকে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবারে পরিণত হতে থাকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মা-বাবার দ্বন্দ্ব, হতাশা এসব তারা বাচ্চাদের সামনে প্রকাশ করতো না। কারণ এতে সবই জেনে যাবে। যখন যৌথ পরিবার ছিল তখন তারা এই পদ্ধতি নিয়ন্ত্রন করতো। কিন্তু এখন তো নিয়ন্ত্রন করার কেউ নেই। মা-বাবা সন্তানের সামনে যেমন তেমন আচারণ করে ফেলেন। বর্তমান সময় তারা মনে করেন সময় বদলাচ্ছে তার সাথে মানুষের মানুসিকতাও পরিবর্তন হচ্ছে।
আজ থেকে এক দশক আগে প্রেম করা নিষিদ্ধ মনে করা হতো। সামাজিক ভাবে এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ রয়েছে প্রেম। তবে নিষিদ্ধ মনে হলেও সমাজে ঘটছে সচরাচর। এক দশকের আগে প্রেমের বিয়েতে অভিভাবকদের ঘোর আপত্তি ছিল। সেই ভেড়াঝাল থেকে দুরে রাখার জন্য ছেলেমেয়েদের বনবাসের মত দুরে সরিয়ে রাখা হতো।
এখন তো যান্ত্রিক শহর জীবনে ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দ করে বিয়ে করলেই মা-বাবা বেশ খুশি হন। দিন দিন সামাজিক রীতিনীতি বদলাচ্ছে, মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের অনুশাষন কাঠামো। মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা যত বাড়ছে, জীবনযাপনের স্বাধীনতাও ততটাই ভোগ করতে চাইছে। পরিবারগুলো ভাঙছে। সমাজও তার আদল বদলাচ্ছে। জীবনযাপনের পুরনো রীতিগুলোও পাল্টাচ্ছে।
মানুষের আশা-আকাংখা, বেড়ে ওঠা সবকিছু ছিল সামগ্রিকভাবে পরিবার কেন্দ্রিক। যৌথ পরিবারে যে কোন সদস্যের চাহিদা পূরণ ছিল পারিবারিক সিদ্ধান্ত। নিজের সন্তানের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসত পরিবারের প্রধানের কাছ থেকে। দাদা, চাচা, মা, চাচী, চাচাত ভাইবোনরাও সমান অংশীদার ছিল পরিবারের যে কোন ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে।
পরিবারের যৌথ কাঠামো এই সামাজিক বন্ধন ও নৈতিক বন্ধন দৃঢ় করতো। বড়দের মানা, প্রত্যেক সম্পর্ককে সম্মান করা, এসব কিছুই তারা শিখতো গুরুজনদের কাছ থেকে। সেই পারিবারিক সম্পর্ক এখন দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। এখন চারপাশে জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। ফলে অসুখী দাম্পত্য, সন্তানের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে, চাওয়া-পাওয়া আর উন্নতির চক্রে ঘুরছে সবকিছু। পারিবার থেকে সন্তানরা সামাজিক অনুশাসন মূল্যবোধ না শিখায় ভাল মন্দ বুঝতে পারছে না।
পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে চলে যাওয়ায় অভদ্রতা, অসম্মান করা আধুনিক ও স্মার্টনেস জ্ঞান বলে মনে করছে। ভদ্রতা, সম্মান করা এই সকল বিষয় পরিবারের কাঠামো দাদা-দাদী, ফুপু, চাচা-চাচীদের কাছ থেকে শিখবে। কিন্তু যৌথ থেকে একক পরিবারে রুপান্তরিত হওয়ার কারনে শিশুটি কাজের মানুষটির কাছে সার্বক্ষনিক থাকায় কিছুই শিখতে পারছে না। তাই শিশুর আদর্শিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন যৌথ পরিবার।
লেখক: সবুজ আলম ফিরোজ
সাংবাদিক
০২ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/ফিরোজ/এফএ