দুলাল মাহমুদ: ক্রিকেট ইতিহাসে সেই ম্যাচটির কোনো গুরুত্ব নেই। থাকার কথাও নয়। ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিবৃত্তে এমন কত ম্যাচই তো আয়োজিত হয়েছে,কে আর তা মনে রাখে? এমনকি যে ম্যাচটি ছিল একটি দেশের মর্যাদার লড়াই,সম্মানের লড়াই,ইতিহাস গড়ার লড়াই, সেই তাদের কাছেও বোধকরি এর তাৎপর্য ও প্রাধান্য অনেকখানি ফিকে হয়ে গেছে। কে আর পুরানো সেই দিনের কথা মনে রাখে? যা চলে যায়,তা বোধকরি হারিয়ে যায়। আসলে কি হারিয়ে যায়? অন্তত যে প্রজন্ম সেই সময় এমন একটি সন্ধিক্ষণকে দেখতে পেয়েছেন, অনুভব করতে পেরেছেন কিংবা শুনতে পেয়েছেন, তাঁদের কাছে এর আবেদন কখনও ফুরিয়ে যায় না,যেতে পারে না। ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার যে সিঁড়ি,সেটিও ফিরে ফিরে আসে ইতিহাসেরই প্রয়োজনে।
সেই দিনটিতে উদগ্রীব হয়ে ছিল পুরো বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশই বা বলি কেন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের নাগরিকরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছেন। এ যেন অবজ্ঞা, অনাদর ও অমর্যাদা থেকে মুক্তির রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। এ ম্যাচে জয়ের সনদ পেলে অনেকটাই বদলে যাবে জীবনের আক্ষেপ,অপ্রাপ্তি ও মনস্তাপ। সঙ্গত কারণেই সেদিন থমকে যায় প্রতিদিনের জীবন। স্থবির হয়ে পড়ে চারপাশ। ইথারে ইথারে সরব হয়ে ওঠে অলি-গলি। জুম্বার নামাজে প্রার্থনার লক্ষ-কোটি হাতে একটিই আর্জি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কান্নাভেজা কণ্ঠে সবারই ছিল একটি প্রার্থনা। গ্লানি থেকে মুক্তি। ব্যর্থতা থেকে মুক্তি। অপারগতা থেকে মুক্তির আর্তি।
বছরের পর বছর স্বপ্নভঙ্গের যাতনা সইতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বইতে হয়েছে অক্ষমতা ও ব্যর্থতার বেদনা। কেউ না কেউ বার বার স্বপ্নগুলো দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। যে কারণে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। আইসিসি ট্রফির একদম শুরুতে পথ আগলে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কা ও কানাডা। লঙ্কানরা খুব দ্রুত নিজেদের অবস্থান গড়ে নেওয়ার পর তাদের নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয়নি। এরপর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় জিম্বাবুয়ে। বেশিরভাগ সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আফ্রিকান এই দেশটি। জিম্বাবুয়ে এলিট ঘরানায় নাম লেখালে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে বাংলাদেশ। যাক, এখন আর কোনো বাঁধা রইলো না। কিন্তু ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কেনিয়া ও হল্যান্ড যখন আইসিসি ট্রফির কোটায় বিশ্বকাপ খেলে,তখন কেন যেন মনে হতে থাকে, এ জনমে বুঝি আর বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা হবে না। তবুও আশা ছাড়তে চায় না মন। সবাই পারলে ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন পারবো না?
১৯৯৭ সালে আকরাম খানের নেতৃত্বে ১৪মার্চ মালয়েশিয়ায় কুয়ালালামপুরে শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন অভিযাত্রা। এ যাত্রা আমাদের দারুণভাবে আশাবাদী করে তোলে। যদিও যাওয়ার আগে বাংলাদেশের ওয়েস্টইন্ডিজের কোচ গর্ডন গ্রীনিজ খেলোয়ারদের উপর অযথা চাপ সৃষ্টি না করতে সবার কাছে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতে কি আর চিঁড়া ভেজে? সেবার আইসিসি ট্রফির সেরা তিনটি দেশের মধ্যে থাকতে পারলে খেলা যাবে স্বপ্নের বিশ্বকাপ। কত, কত দিন এমন একটি স্বপ্ন লালন করে আসছে একটি জাতি। সেই স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশার চাপ তো থাকবেই।
সফরের শুরুতেই সূচক হিসেবে আসতে থাকে একের পর এক অশনিসঙ্কেত। যে দলগুলো আইসিসি ট্রফির প্রধান প্রতিপক্ষ সেই হল্যান্ড, কেনিয়ার কাছে প্রস্তুতি ম্যাচে সহজেই হার মানতে হয় বাংলাদেশকে। মনটা কেন যেন দমে যায়। তবে লড়াইয়ের মাঠে নামার পর প্রথম রাউন্ড পাড়ি দিতে বেগ পেতে হয় নি। প্রতিটি ম্যাচেই জয় আসে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে বাংলাদেশের ম্যাচগুলোতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতি। বৃষ্টিবিলাসী এ জাতির কাছে এটি যেন অভিশাপ হয়ে আসে। বৃষ্টির জন্য হংকং এর সঙ্গে পয়েন্ট ভাগাভাগির পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। যদিও বৃষ্টি বাগড়া দেওয়ার আগেই জয় তুলে নেওয়া সম্ভব হওয়ায় সূচনাটা ভালোই হয়।
আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে খেলায়ও বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। ১২৯ রানের জবাবে বাংলাদেশ ৬দশমিক ১ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলে ২৪ রান। শুরু হয়ে যায় বর্ষণ। খেলা না হলে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে বাংলাদেশ। বৃষ্টি থামার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা শুরু হয়ে যায়। সদয় হন সৃষ্টিকর্তা। বৃষ্টি থামলে টার্গেট দাঁড়ায় ২০ ওভারে ৬৩ রান। এটা কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু মাঠে তখন পানিতে পরিপূর্ণ। খেলা হবে কীভাবে? কিন্তু হার মানতে রাজি নয় বাংলাদেশের মানুষ। ক্রিকেটবিশ্ব যা কখনো দেখেনি,সেদিন তাদের নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়। একটি জাতির স্বপ্নপূরণের যে আকাঙ্খা, যে অভিলাষ, যে অভিপ্রায় তার প্রতিফলন ঘটেছিল রয়্যাল সেলানঙ্গর ক্লাব মাঠে। ম্যাচ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়,কোচ,ম্যানেজার,চিকিৎসক,কর্মকর্তা,সাংবাদিক এবং প্রবাসী দর্শকরা মিলে এক অনন্যসাধারণ কাজ করেন। পানি নিষ্কাশন করে মাঠ খেলার উপযোগী করার জন্য যে যেভাবে পারেন, তাতে সর্বাত্মক ঝাঁপিয়ে পড়েন। মাঠ প্রস্তুত করাটা ছিল দুঃসাধ্য এক মিশন। কিন্তু সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়। এমনকি কেউ আঁজলা ভরে, কেউ গায়ের শার্ট ভিজিয়ে পানি শোষানোর কার্পণ্য করেন নি। বাধ্য হয়ে খেলা শুরু করেন আম্পায়াররা।
কিন্তু আইরিশরা যে ছলকলায় পারদর্শী, সেদিন সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায়। তিন বল খেলার পর শুরু হয় তাদের অভিনয় কৌশল। আম্পায়ারদেরও মনে হতে থাকে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের চরিত্র শাইলকের মতো। আইরিশ খেলোয়াড়রা মাঠ অনুপযুক্ত দাবি করলে আম্পায়াররা সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দেন। ন্যায্য বিচার পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী বালথাজাররুপী পোর্শিয়া ছিলেন না। এ কারণে এত উদ্যোগ, এত প্রচেষ্টা,এত প্রত্যাশার পরও অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয় বাংলাদেশকে। পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক চাপে পড়ে যায়।
দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে যেভাবেই হোক হারাতে হবে হল্যান্ডকে। এটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ভাগ্য পরীক্ষার ম্যাচ। এ ম্যাচে জিতলেই কেবল সেমিফাইনাল খেলতে পারবে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী। ১৯৮২ সালের পর তাদের হারানোর রেকর্ড নেই বাংলাদেশের। দিন কয়েক আগে প্রস্তুতি ম্যাচেও তাদের কাছে হারতে হয়েছে। যাহোক, টস হেরে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ডাচরা তোলে ১৭১ রান। এই স্কোরকে খুব বড় কোনো চ্যালেঞ্জ মনে হয় নি। কিন্তু ১৫ রানেই টপঅর্ডারের চার ব্যাটসম্যান নাইমুর রহমান দুর্জয়, সানোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আতাহার আলী খান একে একে ফিরে যাওয়ার কথা বেতারের ধারাবিবরণীতে শোনার পর বুকের মধ্যে এক একটি শেল হয়ে বিঁধছিল। দিনটি ছিল চার এপ্রিল। এ কারণেই কিনা টি এস এলিয়টের কবিতার লাইনটি মনের কোণে ভিড় জমায়, APRIL is the cruellest month, এটিও আশঙ্কার কারণ হয়ে ওঠে। এ ম্যাচে হেরে গেলে বিদায় হয়ে যাবে বাংলাদেশের। আবারও স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কায় আক্রান্ত হয় পুরো দেশ।
তবে বাংলাদেশ ১৮ দশমিক ৫ ওভারে ৫৬ রান করার পর আর্শিবাদ হয়ে আসে বৃষ্টি। সে সময় বৃষ্টিকে খুবই রোমান্টিক মনে হতে থাকে। মদন মোহন তর্কালঙ্কারের ছড়াটিকে মধুর মনে হয়, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ধান দিব মেপে/লেবুর পাতা করমচা/যা বৃষ্টি ঝরে যা।’ তখন খেলা শেষ হলে বাংলাদেশ জিতে যায়। তাই ময়ূরের মতো খুশিতে নেচে ওঠে হৃদয়। কিন্তু ২০ ওভার খেলা হলেই নির্ঘাত বিদায় নিতে হবে বাংলাদেশকে। সেক্ষেত্রে টার্গেট দাঁড়াতো ২০ ওভারে ৭৭ রান। আমাদের চাওয়া মতো তো আর সব কিছু হওয়ার নয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে তো সবাই সমান। প্রতিপক্ষরা নিশ্চয়ই তাঁর স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সে কারণেই কিনা এক ঘণ্টা পর থেমে যায় বৃষ্টি। সেই মুহূর্তে প্রকৃতিদেবতাকে আমাদের কাছে বড় নিষ্করুণ মনে হতে থাকে। ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডে ১৪ দশমিক ১ ওভারে অর্থাৎ ৮৫ বলে ৮৫ রানের কঠিন টার্গেট। অর্থাৎ মোট ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। (সেদিন বোধকরি জানতে পারি ডাকওয়ার্থ-লুইস (ডিএল) মেথড-এর গুরুত্ব সম্পর্কে। ক্রমান্বয়ে শিখতে থাকি নতুন নতুন শব্দ। নতুন নতুন ব্যাখ্যা। নতুন নতুন বিশ্লেষণ। যদিও এ মেথড আজও হৃদয়ঙ্গম হয় নি।)
ভিজে আউটফিল্ড। সার্বক্ষণিক বৃষ্টির আশঙ্কা। সব মিলিয়ে আবারও যেন নিরাশার বালিতে মাথা কুটে মরার দশা। অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়ে বুকের মধ্যে হাহাকার নিয়ে বাজতে থাকে, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর/ বেদনার বালুচরে/নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে/নিশি দিন খেলা করে/হায় গো হৃদয় তবুও তোমার/আশা কেন যায় না/যতটুকু যায় কিছু তার পায় না/কিছু তার পায় না/কে জানে কেন যে আমার আকাশ/মেঘে মেঘে শুধু ভরে।’ কিন্তু সেদিন একজন ছিলেন স্থির, অচঞ্চল ও অটল পাহাড়ের মতো অবিচল। কিছুই যেন তাঁকে স্পর্শ করছিল না। তিনি যেন নিয়তির সঙ্গে তাঁর বিশালদেহী শরীরটা নিয়ে পাঞ্জা লড়াই করার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। সেটা আমরা কেউ বুঝতে পারি নি। তিনি হলেন আকরাম খান।
আত্মবিশ্বাস, জেদ আর লড়াকু মনোভাব নিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কখনই নতজানু হন নি। পঞ্চম উইকেটে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে নিয়ে তিনি ৬২ রান যোগ করলে আশার আলো দেখা দেয়। কিন্তু নান্নু রান আউট এবং এর কিছুক্ষণ পর এনামুল হক মণি ফিরে গেলে ফের আশঙ্কার কালোমেঘে ছেয়ে যায় মনের আকাশ। তীরে এসে ডুববে নাতো তরি? তখনও প্রশস্ত বুক আর চওড়া ব্যাট দিয়ে একপাশ আগলে রাখেন অধিনায়ক। সপ্তম উইকেটে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ৫০ রানের পার্টনারশীপ গড়লে তীরের কাছাকাছি পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। বুক চিতিয়ে লড়াই করে দলকে জয় এনে দেন প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ আকরাম খান। ৬৮ রানে অপরাজিত থাকেন। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটির জন্য বদলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। ব্যক্তিগত একটি ইনিংস যে একটি জাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল, সেদিন সেটা আমরা পলে পলে অনুভব করেছিলাম।
এ ম্যাচে হেরে গেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কফিনে অনেকটাই ঠোকা হয়ে যেত শেষ পেরেক। কিন্তু এ দিনটি নিয়ে আসে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার বার্তা। ছুটতে থাকে আনন্দের ফোয়ারা। যদিও সেই দিনটি দুই দশক পেরিয়ে এসে এখন বলতে গেলে অনেকটাই উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। অথচ দিনটি ছিল অনেক অশ্রু আর আনন্দের সংমিশ্রণে গড়া। কী যন্ত্রণাদায়ক! কী রোমাঞ্চকর! কী শ্বাসরুদ্ধকর! কী শিহরণ জাগানো! এখনও সেই দিনটির কথা ভাবলে শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। যদিও সেই দিনটিতে কোনো ইতিহাস লেখা হয় নি। তবে দিনটি ছিল ইতিহাস গড়ার সোপান।
তারই ধারাবাহিকতায় ৯ এপ্রিল রচিত হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন ইতিহাস। ৮ এপ্রিল সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের মুখোমুখি হয় আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ। এ ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ নির্ধারিত ৫০ ওভারে তোলে ২৪৩ রান। ফিফটি আসে টপঅর্ডারে ব্যাট করতে নামা খালেদ মাসুদ পাইলট আর আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ব্যাট থেকে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে খেলা পরের দিন রিজার্ভ ডেতে গড়ায়। দুই স্পিনার মোহাম্মদ রফিক ও এনামুল হক মণির ভেল্কিতে ১৭১ রানে গুটিয়ে যায় স্কটিশরা। ৭২ রানে জয়ী হওয়ার ফলে পূরণ হয় বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। প্রথমবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার কৃতিত্ব অর্জন করে বাংলাদেশ। অভিষিক্ত হয় গৌরবের আসনে। এ দিনটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশ। হোলি উৎসবের মতো রঙিন হয়ে ওঠেন ক্রিকেটানুরাগীরা। এত উচ্ছ্বাস,এত উল্লাস,এত স্ফূর্তি খুব কমই দেখা গেছে। কেন জানি না,সেই দিনটিতে গাড়িতে বসা অবস্থায় অঝোর ধারা ঝরতে থাকে অশ্রু। দূর থেকে এই অশ্রুটুকুুই ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য আমার আন্তরিক নিবেদন ও ভালোবাসা। অবশ্য সে দিনটিতে অনেকেরই নীরব অশ্রুপাত হয়।
১২ এপ্রিল আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়ার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। যদিও এ ম্যাচে জয়-পরাজয়ের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবের সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না। আফ্রিকান এ দেশটি তখন হেলাফেলার দল ছিল না। স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানের ইনিংসে উপর নির্ভর করে কেনিয়া নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে তোলে ২৪১ রান। বৃষ্টির কারণে খেলা পরের দিন রিজার্ভ ডেতে গড়ালে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাট করতে নামে। সেদিনও বৃষ্টি দিয়ে শুরু হয় দিন। খেলা হবে কি হবে না, তা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। সংশয় দূর করে শেষ পর্যন্ত ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডে টার্গেট দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। শ্বাসরুদ্রকর এ ম্যাচে খেলার ফল নির্ধারিত হয় শেষ বলে। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১১ রান। ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মেরে আলোড়ন সৃষ্টি করেন খালেদ মাসুদ পাইলট। এ ছক্কার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কও। এমন ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল। এ ছক্কার সাহায্যে শ্বশুরের মন গলাতে সক্ষম হন তিনি।
দুই পরিবারের অমতে প্রায় সাড়ে চার মাস আগে ফারজানা মাসুদ দীবাকে বিয়ে করেন। এ বিয়ে তাঁর শশুর একদমই মেনে নিতে পারেন নি। ছক্কা মেরে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটানুরাগীদের বুকের চাপ কমিয়ে আনার পাশাপাশি শ্বশুরের মন গলাতেও সক্ষম হন। এরপর থেকে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়। অবশ্য তখনও জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারে নি বাংলাদেশ। শেষ বলে লেগ বাই থেকে জয়সূচক রান নেওয়ার জন্য জীবনপণ দৌড় দিয়ে সে সময়কার দ্রুততম মানব কানাডার ডোনোভান বেইলিকেও বোধকরি ছাড়িয়ে যান হাসিবুল হোসেন শান্ত। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষে বীরদর্পে ফিরে আসে বাংলাদেশ দল।
সেদিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোট্ট একটি স্মৃতি। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের বরণ করে নেন সে সময়কার যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তখন ইলেকট্রোনিক মিডিয়া বলতে সবেধন নীলমণি বাংলাদেশ টেলিভিশন। গর্ডন গ্রীনিজের সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রয়োজন বিটিভির। কিন্তু ক্যামেরা থাকলেও তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার কেউ নেই। তখন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সামনে পেয়ে আমাকেই গ্রীনিজের সাক্ষাৎকার নিতে বলেন। অগত্যা অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। তবে সোফায় গ্রীনিজের পাশে বসে নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হয়েছিল। কী প্রশ্ন করেছিলাম, এখন আর মনে নেই। বিটিভির সেই ফুটেজ সংরক্ষিত আছে কিনা কিংবা কোনো আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় সেই মুহুর্তটি বন্দি হয়েছে কিনা জানি না। থাকলে আনন্দদায়ক একটি ক্ষণের স্মৃতি ফিরে দেখতে পারতাম।
বিকেলে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে মানিক মিয়া এভিনিউতে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় গর্বিত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে। সেই গর্ব,সেই গৌরব বহন করছে আজকের বাংলাদেশের ক্রিকেট। মার্কিন কবি এলিয়ট এপ্রিলকে নিষ্ঠুর ও নির্দয় মাস হিসেবে অভিহিত করলেও বাংলাদেশে এ মাসে উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই এপ্রিলে পালাবদল ঘটে বাংলাদেশের। ক্রিকেট হয়ে ওঠে একটি জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। আর এর উৎস ছিল চার এপ্রিল এবং আকরাম খান। এ দিনটির কথা কি কারো মনে পড়ে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এমটিনিউজ২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
৪ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস