পাঠকই লেখক ডেস্ক : জাকারিয়া অপেক্ষা করিতেছে ওয়াহিদা আসবে বলেছে,ওর নাকি কি কাজ আছে জাকারিয়াকে সাথে থাকতে হবে।জাকারিয়া জিজ্ঞেস করেনি কি কাজ,জানি বলবে না।এই মেয়েটা এ রকমই সে যতক্ষণ নিজে না চাইবে কিছু বলবেনা।
ওয়াহিদার আসার কথা বারোটায়।এখন বাজে সারে দশটা। এখন ও অনেক্ষণ বাকি।কিন্তু ওয়াহিদার জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে জাকারিয়ার।টানা দশ বছর অপেক্ষা করেই যাচ্ছে জাকারিয়া।অপেক্ষা জিনিষটা কষ্টের,কিন্তু জাকারিয়ার ভালো লাগে।
এই একটা জিনিষই তো আছে ওর,একান্ত নিজের,যার জন্য কারো অনুমতি নিতে হয়না। জাকারিয়া ঘড়ি দেখল দশটা পঁয়ত্রিশ বাজে।সময় যেন এগোচ্ছে না।এই দশটা বছর কি এমন গতিতে গেছে?না খুব দ্রুত চলে গেল (জাকারিয়া নিজেকে প্রশ্ন করিতেছে)
জাকারিয়া চোখ বন্ধ করল,চোখের সামনে ভেসে ওঠল সেই দশ বছর আগের জাকারিয়াকে।কিছুটা গম্ভীর,কিছুটা চঞ্চল।সারাদিন টো টো করে বেরানু বাঁদরামি করে রাতে বাসায় ফিরে ঠিকই বই নিয়ে বসা,আর সাথে সাথে পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে ওয়াহিদা দুরন্ত আর চঞ্চলতার জ্বলন্ত উদাহরণ। একটু স্থির হয়ে থাকতে পারে না,ক্লাসের সব সহপাঠীর নাড়িনক্ষত্র তার মুখস্থ।সবাই কে ঝাড়ির উপর রাখাটাকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে সে।দুপুরে খাস নাই কেন?জ্বর নিয়ে ক্লাসে আসলি কেন?পরশু পরীক্ষা আর তোই এখন শপিং এ এমন অসংখ্য খবরদারি।
জাকারিয়ার আড়ালে পড়ার ব্যাপারটিও তার অজানা নয়।থাকার কোনো কারণ ও নেই অবশ্য।ওরা ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড।একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলত না এমন নয়,কিন্তু ওরা একজন আরেকজন কে ছাড়া কিছুই করত না।
বন্ধুরা খুব খেপাত,দুজনের কেউ দেরি করে আসলে জিজ্ঞেস করত,কিরে তোর বয়ফ্রেন্ড/গালফ্রেন্ড আসে নাই?জাকারিয়া হাসতো কিন্তু ওয়াহিদা ক্ষেপে যেত।
-কিরে?তুই ওদের কিছু বলস না কেন?(ওয়াহিদা)
-কি বলব? (জাকারিয়া)
-দাত না কেলিয়ে সুজা সাপটা বলে দিতে পারিস না ফাজলামো না করতে, (ওয়াহিদা)
এই ছিল জাকারিয়া আর ওয়াহিদা।ছোট বেলার ফ্রেড।একসাথেই বেড়ে ওঠা।দুজনে দুজনকে যেন খোলা বই এর মতো পড়তে পারে।
এই ওয়াহিদা কেন যেন হঠাৎ করে বদলে যায়।কারো সাথে বেশি কথা বলে না,এমনকি জাকারিয়ার সাথে ও না। হাসে কিন্তু সেই হাসি ওয়াহিদার নয়,কথা বলে কিন্তু তা ওয়াহিদার গলার আওয়াজ নয়।
একটা উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে যেন হুট করেই নিষ্পান হয়ে গেল।
জাকারিয়া চোখ খুললো,চোখটা জ্বলছে,জাকারিয়া আকাশের দিকে তাকাল। (জাকারিয়া এতক্ষন চোখ বুজে কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিল)
আকাশটা এখন ছিঁচকাঁদুনে ভাব নিয়ে বসে আছে,হাসছেও না কাঁদছে ও না।আচ্ছা সেদিন ও কি এরকম ছিল আকাশ? নাহ!সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল, ঝুম বৃষ্টি।
জাকারিয়া হাটতে শুরু করল।আজ এমন কেন হচ্ছে।দশ বছর আগের প্রতিটি জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারতেছে সে। বৃষ্টির বড় বড় ফুটাগুলো জাকারিয়ার গায়ে এসে বিঁধছে।এইতো ওয়াহিদার বাসা।ওয়াহিদা হন হন করে বাসা থেকে আসতেছে। জাকারিয়া আমি একজনকে খুব বেশি ভালবাসি রে, (জাকারিয়ার হাটুতে মাথা রেখে বলেছিল ওয়াহিদা)
ওর চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল জাকারিয়ার হাটুর জায়গা,কিন্তু জাকারিয়া কিছু টের পাচ্ছিল না।ওয়াহিদার কথাগুলো ওকে অসাড় করে দিচ্ছিল।।ওদের অস্তিত্ব কি আলাদা? ওয়াহিদা অন্য কাউকে ভালবাসাতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছিল না জাকারিয়ার,কেন যেন তার খুব রাগ হচ্ছিল।
ওয়াহিদা তার ভালবাসার মানুষকে হারিয়েছিল।কেন,কিভাবে তার সবটা সে জাকারিয়াকে বলেছিল,কিন্তু জাকারিয়া কি আর এ জগতে আছে? সবটাই কানে গেছে,কিন্তু হ্রদয়ে পৌছায় নি কিছুই।শুধু মনে আছে হারিয়েছে শুনে তার অমানবিক আনন্দ হয়েছে।
সেদিন খুব কেঁদেছিল ওয়াহিদা, সেই কান্না জাকারিয়া কে স্পর্শ করতে পারেনি। কোনো সান্ত্বনা দেয়নি সে ওয়াহিদাকে, বের হয়ে এসেছিল ওদের বাসা থেকে।
রাগ হোক আর অভিমানই হোক সেই একদিন হয়েছিল জাকারিয়ার, ওয়াহিদার উপর। বাকিটা সময় ও ওয়াহিদার পাশেই থেকেছে সবসময়। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল মেয়েটা, সবাই ভেবেছিল কদিন যেতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি, বিষণ্ণতার যে একটা পাকাপাকি ছাপ ওয়াহিদার উপর পরেছিল তা আর সরেনি। জাকারিয়া ছাড়া আর কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ ছিল না ওয়াহিদার । জাকারিয়া ও সবকিছু ছেড়ে শুধু ওয়াহিদা কে নিয়েই পড়েছিল।
হাসি পেল জাকারিয়ার। কত ছেলেমানুষিই না করেছে সে। ওয়াহিদা কে তার ভালবাসার মানুষের কাছে পৌঁছানোর কতই না চেষ্টা! বন্ধুত্ব আর প্রেমিকস্বত্বা দুটোই কাজ করছিল জাকারিয়ার মাঝে। মহৎ হওয়ার একটু ইচ্ছাও কি ছিল? হয়ত!
জাকারিয়া ওয়াহিদা কে ভালবেসেছিল। সে ভালবাসার উৎপত্তি ওদের ছেলেবেলার বন্ধুত্ব থেকে নয়, তার জন্ম হয়েছে ওয়াহিদার ভালবাসা থেকে! সত্যিই তাই, জাকারিয়া ওয়াহিদার ভালবাসার প্রেমে পড়েছিল! এত ভালবাসতে জানে মেয়েটা? কেমন করে পারে সে? সেই ছেলেবেলায় কবে কাকে ভালবেসেছে, তার কোন খোঁজ নেই কিন্তু ভালবাসাটা ওয়াহিদা নিজের মাঝেই বাঁচিয়ে রেখেছে, জাকারিয়ার কাছেও তা প্রকাশ করে না, কিন্তু জাকারিয়া বুঝতে পারে।
পকেট থেকে মুঠোফোনের ভাইব্রেট এ ধ্যান ভাঙল জাকারিয়ার।
-হ্যালো (জাকারিয়া)
-কই তুই? (ওয়াহিদা)
জাকারিয়া চারপাশে তাকাল। হাটতে হাটতে বেশ অনেকটা দূর চলে এসেছে সে।
-তুই দাড়া আমি দুই মিনিটে আসছি (জাকারিয়া)
ওয়াহিদাকে কিছু আর বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন টা কেটে দিল জাকারিয়া । আজ মনে হচ্ছে ওয়াহিদা টা না আসলেই ভাল ছিল। কেন যেন আজ ‘শুধুই বন্ধুত্বের’ ভণ্ডামিটা করতে ইচ্ছা হচ্ছে না! দশ বছরের সাধনা টা আজ চুরমার করে দিতে ইচ্ছা করছে।
(ভালবাসি হয়নি বলা তবুও ভালবাসি ”... কত অসংখ্য বার সে শুনিয়েছে ওয়াহিদা কে এই গান টা কিন্তু ওয়াহিদা বুঝতে পারেনি এর মানে কি।)
ওয়াহিদা আজ শাড়ি পরে এসেছে। নীল রঙের। অনেকদিন পর সুন্দর করে সেজেছে, কপালে টিপ চোখে কাজল। আর হাতে বিশাল সাইজের ঝোলা।
-বাসা থেকে ভাগার প্লান করে এসেছিস নাকি? ঝোলার মধ্যে কি আবার (জাকারিয়া) (মুখ টিপে হাসল ওয়াহিদা।)
-চল লেকের পাড়ে গিয়ে বসি (ওয়াহিদা) ।
দুজন হাটতে হাটতে লেকের পাড়ে সিঁড়ির উপর গিয়ে বসলো। ঝোলাটা জাকারিয়ার দিকে এগিয়ে দিল ওয়াহিদা। কিছু কার্ড, শুকনো ফুল, আর কিছু বই আছে সেখানে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল জাকারিয়া? জাকারিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করল (ওয়াহিদা), ওর মুখটাও দেখতে পাচ্ছিল না জাকারিয়া ।
“জানিস জাকারিয়া, ভালবাসা কি ব্যপার টা আমি কোনদিন বুঝিনি, না বুঝেই ভালবেসেছিলাম। মানুষটা চলে গিয়েছিল, তার দেয়া কার্ড আর ফুলগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিলাম, ভেবেছি এটাই ভালবাসা... চারপাশের মানুষগুলোর এত দ্রুত প্রেমে পড়া আর তার থেকেও দ্রুত ‘প্রেম থেকে পড়া’ দেখে আস্তে আস্তে অহংকারী হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি সবার থেকে আলাদা, কেউ আমার মত ভালবাসতে জানেনা।
সত্যিই তাই... এইযে দেখ না... কয়েকটি জড়পদার্থ নিয়ে বসে ছিলাম এত-গুল বছর আর একটা রক্তমাংসের মানুষের ভালবাসাই বুঝলাম না? একজন মানুষ হাজারবার ভালবাসি বলেও সেই ভালবাসাকেই পায়ে ঠেলে চলে গেল,আর আরেকজন মুখে একবারও ভালবাসি না বলেও আজীবন তার প্রমাণ দিয়ে গেল, আর আমি কিনা সেই পায়ে ঠেলা ভালবাসার স্মৃতিই বয়ে বেড়াচ্ছি এতকাল ধরে... কি বোকা আমি দেখেছিস???
আমি ভালবেসেছিলাম জাকারিয়া, কিন্তু তার পূর্ণতা পেয়েছে তোর হাত ধরে। (ওয়াহিদা)
আজকে এই জড়পদার্থগুলো কেন যেন একেবারেই মূল্যহীন মনে হচ্ছে, তোর সাথে কাটানো মুহূর্তই বার বার মনে পড়ছে... কেন এমন হচ্ছে বল তো?”(জাকারিয়া)
ওয়াহিদা ভেজা চোখ নিয়ে জাকারিয়ার দিকে তাকাল। সে তার হাত টা বাড়িয়ে দিল...
জাকারিয়া , তুই কি আমার হাত টা একটু ধরবি? প্লিজ?” (ওয়াহিদা)
জাকারিয়া ওয়াহিদার বাড়ানো হাতটি ধরল, পাগলী একটা... তোর না বাড়িয়ে দেয়া হাতটাই তো সেই কবে ধরেছিলাম আমি, সে তো ছাড়ার জন্য নয়! কিন্তু মুখে সে কিছুই বলতে পারল না, বরাবরের মতই জাকারিয়া !
অন্য হাত দিয়ে ওয়াহিদার চোখ মুছিয়ে দিল। মনে মনে বলল,
“মেয়েরে... তুমি আমার জন্য দু-ফোটা চোখের জল ফেলেছো! তার প্রতিদানে আমি, জনম জনম কাঁদিব।"
লেখক : জাকারিয়া আহমেদ
এমটিনিউজ২৪/এম.জে /এস