বৃহস্পতিবার, ০২ নভেম্বর, ২০১৭, ০৭:১৭:০৬

'পেঁয়াজ রাজনীতি'র সাদামাটা অংক

'পেঁয়াজ রাজনীতি'র সাদামাটা অংক

জুবায়ের আল মাহমুদ: আমাদের দেশে 'রাজনীতি' শব্দটি বহুল প্রচারিত। পার্টি অফিস থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কিংবা জনসভার মাঠ, সবখানটা দখল করে রয়েছে রাজনীতি।

রাজনীতির কবল থেকে বাদ পড়েনি খেলার মাঠ, খেলা ও খেলোয়ার উন্নয়ন বোর্ড। মসজিদ উন্নয়ন কমিটি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বাজার উন্নয়ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক ইশরায়। যদিও এসব উন্নয়নের মান নিয়ে যেমন রয়েছে প্রশ্ন তেমনি উল্লেখিত জায়গায় নিজেকে শরীক করে বহু মানুষকে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার চিত্রও আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি অহরোহ। তবে ‘পেঁয়াজ রাজনীতি’ কথাটি মোটেও পরিচিত নয়।   

সাধারণ চোখ দিয়ে দেখলে নদীর ওপারটা সবার কাছেই সবুজ মনে হয়, কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে দেখা যাবে উল্টো চিত্র। থমকে যাবেন না, প্রধান বিচারপতি কেন বিদেশ গেলেন, কিংবা বিএনপি নেত্রী কক্সবাজারের কুতুপালং গিয়ে কেন শিশু কোলে নিলেন কিংবা বেগম জিয়ার গাড়িতে ছাত্রলীগ নেতার হামলা চালানোর ভিডিও ফুটেজ থাকার পরও আওয়ামী লীগ কেন তা স্বীকার করলো না- আমার আজকের লেখা বিষয় এসব নিয়ে নয়। যদিও রাজনীতির কথা বললে অধিকাংশ জনেরই মনে সাম্প্রতিক এসব ঘটনাই ভেসে উঠবে।   

আসলে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ যে দারুণ কষ্টের মধ্যে আছে-তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকের লেখায় পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ছে এবং এর পেছনে কারণটা কি মূলত সেটাই বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।

শুরুতেই পেঁয়াজের দাম সম্পর্কে একটু ধারণা দেই। এইতো গেল এক মাস আগেও রাজধানীতে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতো ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হতো ২০ থেকে ২৫ টাকায়। কিন্তু এখন এক হালি পেঁয়াজ বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২২ থেকে ২৫ টাকায়। পেঁয়াজের দামের উর্ধ্বগতির কারণেই মূলত আমাদের এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিকেজি পেঁয়াজ এখন ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।    

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, গত এক মাসে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৭১ ভাগ। টিসিবির তথ্য বলছে, গেল বছরও এই সময় বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। সেই হিসেবে এক বছর আগে একটি মাঝারি পরিবার পেঁয়াজের পেছনে যে টাকা খরচ করতো এখন সেই পরিবারকে তার চেয়ে অন্তত চারগুণ টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।  

বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম চড়া হলেও ভারতের চিত্র একেবারেই উল্টো। ভারতীয় পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর তথ্য বলছে, দেশটিতে বর্তমানে বাজারভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ রুপিতে। অথচ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ এই ভারত থেকেই আমদানি করে।   
ভারতে পেঁয়াজের দাম কম হলেও বাংলাদেশে কেন তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে? আমার ধারণা তিন কারণে দেশীয় বাজারে পেঁয়াজের উর্ধ্বগতি থামানো যাচ্ছে না। এক. অজ্ঞতা। দুই. উদাসীনতা। তিন. রাজনীতি।

আসুন এবার বিষয়গুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করি। পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে অজ্ঞতা দায়ী। এর কারণ হলো এ বছর দেশব্যাপী অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে। অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে দেশের বেশ কিছু বড় গুদামে পানি জমে মজুদকৃত পেঁয়াজ যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর কৃষকের নতুন বীজতলাও নষ্ট হয়েছে অসময়ে বৃষ্টির কারণে। এ বছর অধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত হবে- আবহাওয়া অধিদপ্তর বার বার এমন তথ্য জানালেও অজ্ঞতার কারণেই যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। যদিও এর অনেকগুলো বিকল্প উপায় ছিল। অন্তত আমদানির ক্ষেত্রে একমাত্র ভারতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নতুন বাজার খোঁজা যেত।    

অজ্ঞতা আর উদাসীনতা প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বার বার দোষ চাপানো হচ্ছে ‘একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর’ দিকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে-  মন্ত্রণালয় সাধু তো? কারণ চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবেও মন্ত্রণালয় অসাধু ব্যবসায়ীদেরকেই দায়ী করেছে। অথচ এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিত্র আমরা খুব একটা লক্ষ্য করিনি।    অবশ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ সারা বছর ঘুমিয়ে থাকলেও বাজারে কোনো পণ্যের দাম যখন চরমে ওঠে তখন দু’একদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে দেখা যায়। তবে বছরের যে সময়টায় মজুদকারীরা মজুদ করেন, ঠিক সে সময় ব্যবস্থা নেওয়ার চিত্র আমরা কোনদিনও দেখিনি। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণেই মূলত মজুদকারীরা বছরব্যাপী ইচ্ছেমতো মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার দৃষ্টতা দেখায়।   

এবার ছোট্ট একটা অংক মিলিয়ে দিচ্ছি। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণেই যে মজুদকারীরা বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে- তা এই হিসাবটা দেখলে সহজেই বুঝা যাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই চাহিদার বিপরীতে দেশে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসাবে ২ লাখ টন ঘাটতি থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৮৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ আমাদের চাহিদা ২২ লাখ মে. টন। উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ মে. টন। আর আমদানি করা হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার মে. টন। সেই হিসাবে এখন দেশের বাজারে ৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এই পেঁয়াজের হিসাব কে দেবে? মজুদকারীদের সঙ্গে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আঁতাত আছে কিনা- এখন এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে খুব বেশি ভুল হবে কি?

চলুন এবার পেঁয়াজের মধ্যে রাজনীতির কোনো বিষয় আছে কিনা তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করি। আমার ধারণা উদাসীনতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে পেঁয়াজ রাজনীতির মূল রহস্য। ওপরের সাদামাটা হিসাব যদি কারো বুঝতে অসুবিধা না হয়, তাহলে এক কথায় তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এসব তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে থাকার পরও কেন মজুদকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা আমরা লক্ষ্য করছি না-সেটাই আশ্চর্যজনক বটে। পর্দার আড়ালে মজুদকারী ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো গোপণ সমঝোতা হয়েছে কিনা- তার উত্তর হয়তো আমি দিতে পারবো না। তবে মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি যেভাবেই হোক পেঁয়াজের দাম কমিয়ে বাজার স্থিতিশীল করতে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসবে-এমন প্রত্যাশা করা কি অন্যায় হবে?

লেখক: জুবায়ের আল মাহমুদ
সাংবাদিক, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী

এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে