Sohelmd Rana: ইদানিং মুহিনের এভোয়েট করাটা নীরাকে খুব কষ্ট দেয়। অনেক কষ্টেও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না নীরা। অথচ কিছুদিন আগেও নীরাকে একবার ফোন না করলে, দু তিন দিন দেখা না করলে মুহিনের কিছুই ভাল লাগতো না। একটা সময় ছিল নীরাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে হুট তুলে না দেয়া পর্যন্ত সে সস্তি পেতো না, বাসে তুলে দিয়ে জানালা দিয়ে কথা বলত বাস ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত। একদিন তো বাসে করে বাসা অবধি দিয়ে আসল। প্রায় ২০-২৫ কিলো। ফেরার সময় আর বাস পায় না। কারণ বিরোধী দল হরতালের ডাক দিয়েছে। কি বিপদ! তারপর অনেক কেষ্টশিষ্টে এক ট্রাকে করে রাত প্রায় বারটার দিকে ভার্সিটির হলে ফিরেছে। এত কথা বলার একটাই কারণ আগে মুহিন কতটা ভালবাসতো নীরাকে।
নীরার ভালবাসাটা ছিল নিখাঁত।
ভার্সিটির ভর্তি কোচিং করতে গিয়ে তাদের পরিচয়। প্রথমে ভাল ফ্রেণ্ড ছিল। একসাথে গ্রুপ স্টাডি করতো। দুজনেরই উদ্দেশ্য ছিল একটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। সময় সাঁতার কাটছিল সময়ের সমুদ্রে। একসময় এডমিশন টেস্ট হলো মুহিন চান্স পেলেও নীরা পেল না। নীরা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন নিল। দুজনেই বিবিএ পড়ছে। দুজন দুদিকে পড়ালেখা করলেও বন্ধুত্ব অটুট রইল। একজন আরেকজনের খোঁজ খবর মাঝে মধ্যে নিতো। এভাবেই চলছিল তাদের দিনগুলি।
নীরা দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। খুব মিশুক,বাস্তববাদী আর ম্যচিউরড। তার চিন্তা-ভাবনা ছিল যুক্তি নির্ভর। অপর দিকে, মুহিন গ্রামের ছেলে শহরে এসেছে বেশি দিন হয়নি। কলেজ জীবনের দু বছর আর কোচিং এর এ কয়দিন। সে মেধাবী কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা কম। স্বভাব মিনমিনে,আচরণে বিনয়ী, নরম সুরে কথা বললেও তার বিদ্যার অহংকার আছে কিঞ্চিত।
একদিন মুহিন নীরাকে অফার করে বসলো। নীরা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল যে আমরা ভাল ফ্রেণ্ড থাকি সেটাই ভাল। না। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথার মধ্যেও মুহিন তাকে আরো কয়েক দিন ব্যাপারটা নিয়ে কথা তুলল। নীরাকে ভাবতে বলল।
কেয়রিং করা ছেলেদের কিন্তু মেয়রা পছন্দের তালিকায় ওয়েটিং লিস্টে হলেও রাখে তা যত সুন্দর বান্দর আর বদখত ছেলেই হোক না কেন। এক সময় নীরা রাজি হয়। তারা বেশ ভাল সময় কাটাচ্ছিল। তাদের বোঝাপড়াটাও ভাল ছিল।
মুহিন অকপটে স্বীকার করল নীরার কাছে যে সে কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে পছন্দ করতো। তবে সে নীরার মত সুন্দরী ও স্মার্ট ছিল না। সে সময় ঐ মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় কিন্তু মুহিনের পক্ষে কিছুই করার ছিল না। আর কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলের পক্ষে সে সময় কিছু করারও থাকে না। আবার নীরাও বললো তাকে স্কুলে থাকতে একটা ছেলে খুব পছন্দ করতো। তারপর তারা ঐ এলাকা ছেড়ে চলে আসার দিন সে জানতে পারে ছেলেটা হাত কেটে নাকি "নীরা আমার জান" লিখেছিল। শুনে নীরার মায়া হয়েছিল কিন্তু আর কিছুই করার ছিল না।
প্রেমে পড়লে মানুষ নিষ্পাপ হয়ে যায়। প্রেমিকার সামনে সব সত্য কথা বলে। আর বাড়িতে সব সময় মিথ্যা বলে। ওদেরও তাই হয়েছিলো। দুজন দুজনের দোষ আজর করে নিয়ে সম্পর্কের জাল বুনতে লাগল। প্রায়ই মুহিন তার ক্যাম্পাসে নীরাকে আসতে বলতো এবং আসতো। মুহিনকে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাতে হতো। এজন্য ওর উপর কখনো নীরা চাপ সৃষ্টি করতো না গিফট বা ট্রিটের জন্য। ফেস বুকে ওরা সময় কাটাতো। মুহিনের জন্মদিনে নীরা সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় গিফট করত যা পড়লে নীরা দেখে মন জুড়াত।
নীরা আগে বেশ আধুনিক পোষাক পরিধান করতো আজকাল হিজাব পড়ছে, নামাজ কালাম বেশ ধরেছে। কারণ এগুলোর ব্যাপারে মুহিন প্রভাব বিস্তার করে। সাপ এবং মেয়ে মানুষ একবার বস মানলে শুধু সিগন্যালেই কাজ করে। নীরার বলায়ও তা প্রযোজ্য। ও যেন একটু বেশিই ভালবেসে ফেলেছে মুহিনকে। মুহিন যা বলে সে তাই করে। প্রেমে পড়লে ছেলেরাও কম যায় না স্বামীর চেয়ে বেশি খবরদারি করে প্রেমিকার উপর।
এখন ওরা দুজনই ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসে গেছে। কি করব, পাস করার পর চাকরি বাকরি, ঘর সংসার কে কি সামলাবে, দুই পরিবারের কি ভাবনা ইত্যাদির।
প্রথম দ্বন্দ লাগল দুজনের মধ্যে এই নিয়ে যে মুহিন নীরাকে চাকরি করতে দেবে না। কেন? কারণ তাদের পিরবারের কোন মহিলা চাকরি করে না। তাহলে আমি এত পড়া লেখা করে কি করব? নীরা বলল। আমার বাবা কত টাকা খরচ করে আমাকে তাহলে কেন পড়াল? তুমি জানো, আমার অন্য ভাই বোনেরা সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমি চান্স পায়নি তাই বাবা প্রাইভেটে পড়াচ্ছে এবং বেশ টাকা খরচ হচ্ছে। এসব শুনে মুহিনের বক্তব্য এমন - তোমার বাবার অনেক টাকা আছে তাই সে পড়াচ্ছে। আর মেয়েরা হায়ার স্টাডি করে চাকরি না করে সংসার করছে না? নীরা হতাশ। নীরা বলল তোমার আমার দুজনের ইনকামে আমরা ভাল চলতে পারবো। আর তাছাড়া তোমাদের...। কথাটা শেষ না হতেই মুহন বলল আমার পরিবার, আমার দারিদ্র, আমার সীমা বদ্ধতা নিয়ে কেউ কথা বলুক আমি তা চাইনা। এতোক্ষনের আলোচনা সব শেষ। রাগ করে মুহিন চলে গেলো। নীরা নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল।
এভাবে আরো কয়েকবার ওর সাথে এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা উঠলেই মুহিন জানি কেমন পাশ কেটে যায়। ব্যাপারটা নীরাকে ভাবিয়ে তুলছে। অথচ কিছুদিন আগে মুহিনকে নিয়ে সে তার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়েছে। সবাই বিষয়টা জানে। একটা ছেলে সমাজকে যতটা সহজে ম্যানেজ করতে পারে একটা মেয়ে বা তার পরিবার তা পারে না। নীরা খুবই দুশ্চিন্তায় আজকাল দিন কাটায়। ইদানিং ফোন ও ধরে না। একদিন সকালে ক্যাম্পাসে হাজির হল। মাফ চাইল ঠিকাছে তুমি যা বল তাই হবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা জায়গায় মহুয়া গাছের নিচে দুজন বসলো। মুহিন বলল, দেখো আমার ক্যারিয়ারটা আগে তুমি জান আমার রেজাল্ট ভাল আমি এখন এসব বিয়ে টিয়ে নিয়ে কিছু ভাবতে চাইনা। আমি বেশ কিছু কো্র্স করছি ক্যারিয়ার বিল্ডাপ করতে। আমাকে তুমি এসময়ে পেইন দিও না। কি হবে পরে দেখা যাবে। নীরার কোন যুক্তি খাটল না। এক প্রকার অপমান সয়ে চলে গেল নীরা।
বেশ অনেকদিন হলো ফোন দেয়ও না দিলে ধরেও না মুহিন। হঠাৎ রাত ১২ টার দিকে একদিন ফোন ধরল। সেই সাথে নীরাকে যথেষ্ঠ অপমান করেছে এবং অনেক অভিযোগ করেছে - তুমি আমাকে কেয়ার কর না, তোমার পেইন নিয়ে আমার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে, আমাকে আর ফোন দেবেন না, আপনি আমার কাছে অপরিচিতা। এসব শুনে সরারাত কান্নাকাটি করে সকালে চোখ ফুলিয়ে ব্যালকুনিতে বসে ভোরের বৃষ্টি দেখছিলো নীরা। হঠাৎ একটা বুদ্ধি বের করল।
সকাল সকাল বাসা থেকে বের হতে গিয়েই প্রথমে নীরা তার মায়ের সামনে পড়ল। কি রে এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস? মা, আজ সকালে একটা ইমপরটেন্ট ক্লাস আছে। কোই, রাতে বললি নাতো। আর আজকাল তোর কি হয়েছে বলতো? কেমন জানি লাগে আমার। আরে না মা এমনি? আচ্ছা, যা ড্রাইভার এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। থাক মা লাগবে না আমি পবলিক বাসেই চলে যাব। বলেই নীরা মুহিনদের বাসায় নাস্তার টেবিলে হাজির।
সেদিন মুহিন ও হল থেকে বাসায় আসার কথা। মেয়েকে দেখে তো মুহিনের মা হতবাক। তুমি কি সেই মেয়েটা? নীরা স্বভাব সুলভ হাসিতে বলল জ্বী।
তুমি বাসা পর্যন্ত আসছ। ভদ্রমহিলার বিরক্তি দেখে নীরার হাসি এক নিমিষেই উবে গেল।
অতঃপর নীরা লজ্জা সরম ভুলে বলল, দেখন মা,আমি মুহিনকে ভালবাসি ও আমাকে ভালবাসে। আমরা বিয়ে করতে চাই। তারজন্য সময় পরে আপনারা ঠিক করবেন। কিন্তু আপনার ছেলেই আজকাল আমাকে একদম সহ্য করতে পারছে না, আমাকে এভয়েট করছে, সম্পরককে অস্বীকার করতে চাইছে। মা আপনিতো একটা মেয়ে মানুষ আপনিতো বুঝেন কোন অবস্থায় একটা মেয়ে আমার মত ছেলের মায়ের সামনে এসে অধিকার নিয়ে দাঁড়ায়। আপনার মেয়ের সাথে যদি এমন হতো....। মুহিন নিশ্চয়ই আপনাকে আমার সম্পর্কে বলেছে আমি কেমন পরিবারের মেয়ে।
থামো। এক ধমক দিয়ে নীরার সকল দাবি থামিয়ে দিয়ে মা বলল তোমার ব্যাপারে আমি শুধু এতটুকু জানি তোমার জন্য আমার ছেলের লেখাপড়া নষ্ট হচ্ছে। তুমি বাসায় যাও। আর কখনো আমাদের কারো সাথ যোগাযোগ করবে না।
শেষ ভরসাটুকু হারিয়ে কান্নার লোবানে সিক্ত চোখ মুখ হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে উঠল নীরার।
মাস দুয়েক পর নীরা ফেস বুকে আইডি টা ডি এক্টিভ করতে গিয়ে ভাবল, আগে যে আমার জীবনটাকে নিয়ে খলেছে তাকে ডিলিট করে নেই। মুহিনের আইডিটা ওপেন হলো প্রোফাইল পিকচারটা অপরিচিত মনে হলো কারণ সেখানে মুহিনের সাথে একটি অপরিচত মেয়ের হাসিমুখের ক্লোজ সেলফি।
(এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। কারো সাথে কিঞ্চিত মিলে গেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
(সম্পাদক দায়ী নয়)
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস