জান্নাতুল শুভ্রা মনিঃ যুদ্ধ করে পৃথিবীতে স্বাধীন হয়েছে কয়টা দেশ? সংখ্যাটা বেশি নয় মোটেও। তবে এর একটি যখন বাংলাদেশ, তখন বিশ্বের বুকে এ দেশটি কেন আলাদা হবে, কেন বীরের এলাকা বলে এর পরিচিতি হবে না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকী উদযাপন করছে দেশের আপামর জনতা। এতোগুলো বছর ধরে হৈ-হুল্লোরে গোটা বাঙ্গালি জাতি উদযাপন করে আসছে দিনটি মনের আনন্দে। কিন্তু আমি আনন্দিত হতে পারিনি একটা মুহূর্তের জন্যও। তীব্র চাপা কষ্ট প্রতিনিয়ত আমাকে আহত করে,কাঁদায়! আর্তনাদ করে ডুকরে কাঁদি এই দিনটি আসলেই। অতৃপ্তি বাসা বাধে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির কারনে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত মর্যাদা দেয়া হয়নি বলে। ভুলতে পারিনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বাবার অবদান,ভুলতে পারিনা, মানতে পারিনা কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু না পেয়েই তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
আমার বাবার আত্মা এখনও অতৃপ্ত সেই সাথে আমারও। কারন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হয়েও শুধু মাত্র সঠিক মূল্যায়ন না করার জন্য মুক্তিযোদ্ধার কন্যা নামক গৌরবময় উপাধিটিকে মাথার মুকুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না।
আর দু'দিন পরই উদযাপন করবো মহান বিজয় দিবস। বিজয়ের ভোরে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শুরু করবো পবিত্র এ দিনটি। আজন্ম এভাবেই পালন করছি শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস, শহীদ দিবস এবং বিজয় দিবস। বাবার জীবদ্দশায় তার হাত ধরে মধ্যরাতেও শহীদমিনারে ফুল দিতে যাওয়া হতো। এভাবেই ধমনীতে, শোনিতে মিশে আছে শহীদমিনার আর শহীদ স্মৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতা। আর তাই আজ আমি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু কথা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই।
ছাতক থানার পূর্ব দিকের কিয়দংশ এবং ভোলাগঞ্জ (বর্তমানে কোম্পানিগঞ্জ থানা) অঞ্চল ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন “আব্দুল হক এম.এন.এ। সংগঠক ও ক্যাম্প ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যারা ছিলেন, তাঁরা হলেন হেমেন্দ্র কুমার দাস পুরকায়স্থ, কমরেড মানিক মিয়া, ড.হারিছ আলী, ড.আব্দুর রহিম, মদরিছ আলী, বি.এ.এম.এ.খালেক, ময়নুদ্দিন, (শ্রীমঙ্গল) ওআব্দুল গণি,দিরাই। উনারা সকলেই নিষ্ঠার সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।
এ সাব সেক্টরটির কিছু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে ছিল গৌরীনগর যুদ্ধ। রণক্ষেত্রের জন্য গৌরীনগর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে সেখান থেকে সালুটিকরের বিমানবন্দরের দুরত্ব মাত্র ৬-৭ কিলোমিটার। ফলে সালুটিকরে পাক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে আঘাত হানা সম্ভব ছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাম ফ্রন্টের গেরিলা গ্রুপ তৈরির একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছুটা ট্রেনিং এর জায়গা ও পান তারা। সুনামগঞ্জ অঞ্চল হতে এরকম একটি গ্রুপকে ট্রেনিং এ পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা ট্রেনিং সমাপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
এ দলটির মধ্যে সুনামগঞ্জ অঞ্চলের সাইফুর রহমান শামসু, আরপিন নগর,সুনামগঞ্জ, শিবনাথ চৌহান,হাছন নগর সুনামগঞ্জ। বামপন্থি নেতাদের মধ্যে বরুন রায়, আলি ইউনুস এডভোকেট, গুলহার আহমেদ, নজির হোসেন, আব্দস শহীদ চৌধুরী দিরাই, আব্দুল গণি,দিরাই, সৈয়দ আব্দুল হান্নান,জগন্নাথপুর, মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে এবং বামপন্থি গেরিলা বাহিনী তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
দীর্ঘ নয় মাস সেলা ও ইউথক্যাম্প ভোলাগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর সেলা সাব সেক্টরের কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি সমস্ত দায়িত্ব হস্তান্তর করে যুদ্ধ শেষ হবার এগারো দিন পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেই সময় উনার সাথে যারা ছিলেন অনেকের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকলেও আব্দুল গণি (দিরাই) উনার নামটি তালিকায় নাই।
স্বাধীনতার পর তিনি দিরাই উপজেলায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (মরহুম) যুগ্ম সচীব মাইন উদ্দিন খন্দকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিরাই উপজেলায় গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক হিসেবে পাঠাগার গড়ে তোলেন যা আজও বিদ্যমান। এ সময় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক এম.পি “নাছির উদ্দিন চৌধুরী ও সহযোগিতা করেন। এই পাঠাগারে হাজার হাজার বই তিনি সংগ্রহ করে গেছেন। তিনি সুনামগঞ্জ বার্তা, যুগভেরী, জাতীয় পত্রিকা সংবাদ এর সাংবাদিক ছিলেন। আব্দুস সামাদ আজাদ,পীর হাবীবুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত,প্রসুন কান্তি বরুন রায় এবং বঙ্গবন্ধুর খুব স্নেহ ভাজন ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হয়ে গেলো, পার হয়ে হয়ে গেলো বাবার মৃত্যুর ষোলটি বছর। পান নি আজও কোনও স্বীকৃতি রাষ্ট্রের কাছ থেকে। জীবন বাজী রেখে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য। কোনও স্বীকৃতির জন্য যান নি। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্র জাতির পিতার আহ্বানে পায়ের সামনে বিছিয়ে দিয়ে ফিরে এসেছিলেন সাধারন জীবনে।
আমার বাবা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু আজ আমাকে প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হচ্ছে তিনি আদৌ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না! কারন, তাঁর কোন ডকুমেন্ট বর্তমানে আমাদের কাছে নাই। যা ছিল ১৯৮৮সালের ভয়াবহ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় সব কিছু।
আমার বাবা ছিলেন আত্মপ্রচার বিমূখ মানুষ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। কখনো এসবের স্বীকৃতি চান নি। আজ যখন এমন প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হয়েছে আমার মৃত বাবাকে, তাই তার কন্যা হিসেবে আমি চুপ থাকতে পারিনি। কারন,এটা আমার বাবার ন্যায্য অধিকার এবং কন্যা হিসেবে তা প্রমান করা আমার দায়িত্ব।
আমি তাই,আমার বাবাকে নিয়ে লিখা শুরু করলাম তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ড নিয়ে। একটা পর্যায়ে এগিয়ে আসলেন সিলেটের ডাকের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার সাঈদ নোমান। এ ব্যাপারে সাহায্য করলেন আমাকে। আমাকে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য বই দিলেন জসিম বুক হাউস। আমি মুক্তিযুদ্ধেরর উপর অসংখ্য বই পড়তে লাগলাম। মাসুম আহমেদ এবং কে এইচ মামুন ভাইও সাহায্য করেছেন আমাকে।
সিলেট থেকে আমাকে পাঠানো হলো আমার এলাকার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার “আতাউর রহমানের “কাছে। আমি জানতে চাইলাম মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন লিস্টে কি আমার বাবার নাম এসেছে কি না? তিনি এটা শোনা মাত্রই রূঢ় ব্যবহার করলেন আমার সাথে।স্পষ্ট করে বলে দিলেন, আমার বাবা কোন কালেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। উত্তরে আমি বললাম বিনীত ভাবে-আমার বাবা যদি মুক্তিযোদ্ধা না হতেন, তাহলে বইয়ের মধ্যে নাম আসলো কি করে? উনি তখন টিটকারি সুলভ আচরণ করলেন আমার সাথে। কোন রকম সাহায্য তো দূরের কথা উল্টো আমি মেয়ে বলে ক্রিটিসাইজ করছিলেন। উনার সাথে চামচা গোছের যারা ছিল তারাও ক্রিটিসাইজ করছিল। আমি অসহায় বোধ করছিলাম তখন। অসহায় বোধ করছিলাম একারনেই,কারন একজন মুক্তিযোদ্ধার আচরণ এতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে ভেবে। অথচ-এরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিস্টেড করেন। এরকম মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডারদের কারনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বার বার।
আমি হতাশ হইনি মোটেও।বরঞ্চ আরো ও উদ্যম সাহস শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে যাই। প্রচন্ড জেদ চাপে মনে। আমার বাবা মুক্তি যোদ্ধা ছিলেন এটা আমি প্রমান করব যে ভাবেই হোক। সত্যের জয় হবে এটাই বাস্তব।
অবশেষে-মুক্তিযোদ্ধের অসংখ্য বইয়ের মধ্যে একটা বই পেয়ে যাই। বইটির নাম রক্তাক্ত একাত্তর,বইটি লিখেছেন সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের গবেষক সুনামগঞ্জ বারের সাবেক সভাপতি বজলুল মজিদ খসরু। বইটাতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বাবা কথা লিখা আছে। একসময়,উনার সাথে সরাসরি দেখা করি এবং কথা বলি। কথা বলার পর জানতে পারলাম আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
এখন সবচেয়ে বড়,কষ্ট হলো-মুক্তিবার্তায় আমার বাবার কোন নাম নাই। আমি বিভাবে এখন অগ্রসর হবো। বাবার সাথে সহযোদ্ধা যারা ছিলেন,কেউ আজ জীবিত নেই। একমাত্র বজলুল মজিদ খসরু মৌখিক ভাবে সাক্ষী দিতে পারবেন। এখন সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো- মুক্তিবার্তায় আমার বাবার কোন নাম নাই।
আমার বাবা ছিলেন আত্মপ্রচার বিমূখ মানুষ। তিনি মুক্তি যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। কখনো এসবের স্বীকৃতি চান নি। কোনো কিছু পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করে নয়, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখ সমরে। ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। স্বাধীন বাংলার মানচিত্রের জন্য নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি আমার বাবা। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি পাননি কোন স্বীকৃতি।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার বাবা আজ জীবিত নেই। কিন্তু উনার নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি এই জন্য যে,আমার বাবা আজ নেই কিন্তু কিন্তু উনার নাম তালিকা ভুক্ত করলে আমরা তাঁর সন্তান হিসেবে গৌরব বোধ করব ও সম্মানিত হবো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ তো শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে উঠার যে গৌরবময় ইতিহাস তার অপর নাম আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে পুরো বাংলাদেশ বিজয়ী হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ হেরে গেলে যে পুরো বাংলদেশ হেরে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে স্বীকৃতিটুকু দিন। হয়তো বাবা নিজে স্বীকৃতিটি নিজের হাতে নিতে পারবেন না, কিন্তু অপার থেকে ঠিকই দেখে পুলকিত হবেন, হয়তোবা চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ও গড়িয়ে পড়বে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মের জন্যে যে মহান ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন আমার বাবা- হয়তোবা তার সেই ঋণ শোধ করার ধৃষ্টতা আমরা কেউই দেখাবো না। কিন্তু তাঁর নামটি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তালিকাভূক্ত করে তাঁর প্রতি কিছু দায়িত্ব কি আমরা পালন করতে পারি না?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ সরকারের উদ্যোগ কম নয়। কিন্তু আলোর নিচে অন্ধকারের মত বেঁচে থেকে আমার বাবা চলে গেছেন পারাপারে। জীবিত থাকতে শুনে যাননি তিনি একজন স্বীকৃতি প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমার বাবার মতো সুবিধা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্ত করার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে মরোণোত্ত্বর রাষ্ট্রিয় মর্যাদাসহ তাদের কবর সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।
জান্নাতুল শুভ্রা মনি, লেখক,কবি ও ছড়াকার।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস