বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৬:১৫

গ্রামের বাতাসে এখন খেজুরগুড়ের মৌ মৌ গন্ধ

গ্রামের বাতাসে এখন খেজুরগুড়ের মৌ মৌ গন্ধ

জুবায়ের আল মাহমুদ রাসেল: পৌষের সেই হাড় কাঁপানো শীত এখনও শুরু হয়নি তাই গ্রামগুলোতে এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি পিঠাপুলির মহাৎসব। কিন্তু এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে পিঠা তৈরির কাঁচামাল খ্যাত খেজুরের গুড়ের উৎপাদন। এই তো হেমন্ত প্রায় শেষ, প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ধূমধাম করে শুরু হবে বাঙালির আরও একটি প্রাণের উৎসব ‘পিঠেপুলির উৎসব’। সেই উৎসবকে সামনে রেখে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির মেয়েরা এখন একটু বেশীই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রায় সব বাড়িতেই চলছে পিঠা তৈরীর পূর্ব প্রস্তুতি। এই যেমন কেউ নারিকেলের খোসা ছড়াচ্ছেন, কেউ নতুন ধানের কুঁড়ো পরিষ্কার করছেন কেউ’বা আটা-ময়দা তৈরীতে বেজাই ব্যস্ত। আর বাড়ির পুরুষরা ব্যস্ত আত্মীয়-স্বজনদেন দাওয়াত করতে। অনেকে আবার পরিকল্পনা করে রেখেছেন এবার শীতে কে কোন পিঠা তৈরি করবে। ভাবীরা রীতিমত ব্যস্ত ননদিনির বাড়িতে এবারের শীতে কোন কোন পিঠা পাঠানো যায় সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু ভাই সেই পিঠা তৈরির প্রধান কাঁচামাল খেজুরের রসের কি অবস্থা! উৎপাদন কি শুরু হয়েছে ? খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল, আর এই জানার আগ্রহ থেকেই ঘুরতে গিয়েছিলাম গ্রামে। কোন গ্রামে যাব ঠিক ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে ঠিক করলাম অনেক দিন আমার নিজের গ্রামে যাওয়া হয়নি, ব্যাচ যেই চিন্তা সেই কাজ। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম রাজশাহীর বাঘার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার পর বেরিয়ে ছিলাম বলে বাঁসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। রাতের আঁধারে খেজুরের গাছগুলো চোখে পড়ছিল কিন্তু সেই গাছে কলস টাঙানো আছে কিনা বুঝতে পারলাম না। তাই গাছে ভাঁড় দেয়া শুরু হয়েছে কিনা রিক্সাওলার কাছ থেকে জেনে নিলাম। রিক্সাওয়ালার হ্যাঁ সূচক বক্তব্যের পর মনে হতে লাগলো কখন যে খেজুরের রস পান করব! আর সহ্য হচ্ছে না তাই রিক্সাওয়ালাকে একটু দ্রুত যেতে বললাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠব বলে বাড়ি পৌঁছে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমাতে গেলাম। কারণ আমাদের বাড়ি গ্রামে হলেও আমাদের নিজেদের কোন খেজুরের গাছ নেই। কারণ ভোরে উঠে খেজুরের রসের সন্ধানে আমাকে যেতে হবে মাঠের দিকে। শহর থেকে অনেক দিন পর গ্রামে গিয়েছি। কিন্তু শহরে শীত শুরু না হলে কি হবে গ্রামে কিন্তু শীত শুরু হয়ে গেছে। খুব ভোর বেলা উঠে দেখছি কেমন যেন শীত শীত লাগছে। তাই একটি গায়ের চাদর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে দেখা হল বেশ কয়েকজন গাছির (যারা খেজুরের গাছে ভাঁড় বাধে তাদের গাছি বলে) সঙ্গে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা হল আমার বাল্যবন্ধু বাদলের সাথে। তার কাঁধেও দেখছি খেজুর রসের ভাঁড়। ভাঁড়ের মধ্যে স্বচ্ছ ডিস্টিল ওয়াটারের মত খেজুরের রস দেখে আর সহ্য হল না। ব্যাচ ওখানেই ভাঁড়টা একটু কাত করে পান করে ফেললাম বছরের প্রথম খেজুরের রস। আমি প্রতি বছরই খেজুরের রস পান করি কিন্তু বাদলের ভাঁড়ের রস এই প্রথমবার পান করলাম। বেশ ভালই লাগলো। কিন্তু হঠাৎ গাছিদের কষ্টের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। দিনভর প্রত্যেকটি গাছি মাজায় দড়ি বেধে বাদুড়ের মত খেজুর গাছে ঝুলে ঝুলে গাছে রস আহরনের জন্য ভাঁড় বেধে রেখে বাঁসায় ফিরে। তারাই আবার রাতের শেষ ভাগে অনেকটা আয়েশি ঘুম ছেড়ে ভাঁড় নিতে চলে আসে এই মাঠে। ভাঁড়ের রস পান করতে করতে মনে মনে ভাবছিলাম, বাদল নিজেও তো কষ্ট করে গাছ থেকে রস আহরণ করে আমি আবার সেটাতে ভাগ বসাচ্ছি, সে আবার রাগ করছে না তো! হা হা হা। রস পান করার পর বন্ধু আমার আমাকে খেজুরের গুড় খাওয়ার দাওয়াত করায় বুঝলাম সে রাগ না করে উল্টো খুশিই হয়েছে। বাদলের সঙ্গে কথা শেষ করে মাঠের দিকে গেলাম আমাদের নিজেদের আম বাগান দেখতে। অনেক দিন বাদে বাগানের আম গাছ গুলো দেখে নিজেকে প্রবাসি মনে হচ্ছিল! গাছ গুলো অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় বেশ ভাল লাগছিল। মাঠের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বেশ খানিকটা পেরিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৮ টা ১৭। হঠাৎ মনে হল খেজুরের গুড় খাওয়ার কথা। তাই হেঁটে হেঁটে বাদলের বাড়ির দিকে ফিরে আসতে শুরু করলাম। মাঠ পেরিয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকতেই আমার নাকে আসল বাতাসে ছড়িয়ে পড়া খেজুরের গুড়ের মিষ্টি ঘ্রান। প্রায় প্রতিটি বাড়ির লোকজন সবাই রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গুড় তৈরীর এই মহাৎসবে। সেই ঘ্রানের পথ ধরে চলে আসলাম বাদলের বাড়িতে। বাদলের বাড়িতে গিয়ে বেশি দেরি করলাম না। ঢাকায় ফিরতে হবে বলে ভাবীর কাছ থেকে একটু গুড় হাতে নিয়ে খেতে খেতে বাসায় চলে আসলাম। খেজুরের গুড়ের এই মিষ্টি ঘ্রান আমার নাকে এখনও বেধে আছে। যারা কোন দিন এই মিষ্টি ঘ্রান পায়নি খেজুরের গুড় সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা দেয়াটা আসলে খুবই কষ্টকর। তাই শুধু এটুক্ইু বলি আসল মজা যদি পেতে চাও তবে গ্রামে যাও। সত্যিই খেজুরের গুড়ের এই মিষ্টি ঘ্রান এবং স্বাদ কখনও ভুলতে পারবো না। খেজুরের গুড়ের এই মজার স্বাদ মুখে নিয়েই কর্মস্থলে ফিরে আসলাম। লেখক: সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউটে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমায় অধ্যয়ণরত। ই’মেইল: [email protected] ১8 নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে