জাহিদ রহমান: খোদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে এখন এক কেজি টমেটোর দাম গড়ে ১০ থেকে ১৫টাকা। ৩ মার্চ মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে বিভিন্ন জাতের টমোটো বিক্রি হয়েছে গড়ে ১৫ টাকা কেজি দরে। যে টমেটো ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয় সেই টমেটোর এত কম দেখে ক্রেতারাও বিস্মিত না হয়ে পারছেন না। তবে বিস্ময়টা আরো বেশি দেশের বৃহত্তম পাইকারি কারওয়ান বাজারে। কারওয়ান বাজারে টমেটোর কেজি প্রতি পাইকারি দর মাত্র ২ থেকে ৫ টাকা। কারওয়ান বাজারে টমেটো পড়ে আছে। কিন্তু ক্রেতার অভাব। কোথাও ক্রেতা নেই। চাহিদার তুলনায় নাকি সরবরাহ নাকি এতোটাই যে কারওয়ান বাজারেও টমেটোর কোনো ক্রেতাই নেই।
কারওয়ান বাজারের চিত্র দেখে তো সহজেই আঁচ করা সম্ভব গ্রামের কী অবস্থা। ক্রেতা বা পাইকারের অভাবে গ্রামে টমেটোর কেজি এখন মাত্র ১ থেকে ২ টাকা। অনেক জায়গার কৃষকরাই বলছেন এক মণ টমেটো বিক্রি করে এখন এক কেজি মোটা চাউলের দামও হচ্ছে না। ক্ষোভে এবং লজ্জায় অনেক জায়গার কৃষকরা তাই জমি থেকে আর কষ্ট করে শ্রম দিয়ে টমোটো তুলছেন না, তুলতে চাচ্ছেন না। রাগে-দুঃখে জমিতেও যাচ্ছেন না। যাবেনই বা কেন? যদি ক্রেতা না থাকে, চাহিদা না থাকে তাহলে আর কী করবেন।
এমতাবস্থায় দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার একর জমিতে উৎপাদিত টমেটো তাই জমিতেই পচে নষ্ট হচ্ছে। বাজারমূল্য না থাকার কারণে অনেক জায়গাতে টমেটো এখন গরু-ছাগলের খাবারে পরিণত হয়েছে। অনেক কৃষক তাই জমিতে বসে কেবলই চোখের জল ফেলছেন। দায়দেনা কীভাবে শোধ করবেন এনিয়ে মহাচিন্তায় আছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা। কিন্তু এনিয়ে যেনো কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। না নীতি-নির্ধারক বা নেতাদের? কৃষকের অধিকার নিয়ে যে সব উন্নয়ন সংগঠন নিত্য চোটপাট দেখান, কনসালটেশন মিটিং এর নামে যারা আয়েশ করে দুধ চা খান তারাও চুপচাপ। কেবল ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরাই দিন-রাত আহাজারি করছেন। গণমাধ্যমে সেই আহাজারির সংবাদ আসছে।
বাগেরহাটের চিতলমারীর এক টমেটো চাষী বলেছেন, ‘ছেলেমেয়ের চেয়েও বেশি যত্ন করে টমেটো চাষ করেছিলাম। ফলনও ভাল হলো। কিন্তু দাম পেলাম না। ক্ষেতের টমেটো ক্ষেতেই নষ্ট হলো। এই কষ্ট কাকে বলি?’ জামালপুর জেলার চরাঞ্চলের যেসব কৃষক এবার টমেটো চাষ করেছিলেন তারাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। একটি পত্রিকা স্থানীয় কৃষি অফিসের তথ্যমতে বলেছে, জামালপুর সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলসহ মোট ১৭ শত হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করেছিল স্থানীয় কৃষকরা। ফলনও হয়েছিল খুব ভালো। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গরম পড়লে টমেটো দ্রুত পাকতে শুরু করে। কিন্তু ঢাকায় চাহিদা ভালো না থাকায় চাষীদের চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক থেকে দু টাকা কেজি দরে তাদের টমেটো বিক্রি করতে হয়েছে। এতে করে তাদের উৎপাদনের খরচই উঠেনি।
একই ঘটনা ঘটেছে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলাতে। গত ২৭ ফেব্রয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার বিরামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গাতে টমেটো চাষ করেছিল কৃষকরা। প্রথম প্রথম ভালো দামও পেয়েছিল। কিন্তু চাষীদের ভাগ্য খারাপ হতে সময় লাগেনি। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে টমেটোর কোনো চাহিদা না থাকায় ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে টমেটো। আর তাই কৃষকদের এখন চোখের পানি ফেলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মোহনগঞ্জের বামের চর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক আবুল কালাম আজাদ এক বুক দুঃখ নিয়ে বলেছেন, ৩ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করতে গিয়ে তার খরচ হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ টাকা। হাইব্রীড হীরা, উদয়ন এসব জাতের টমেটো চাষ করেছিলেন। ভালো ফলনও হয়েছিল। কিন্তু দাম একেবারে কমে যাওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তার খরচের টাকাই উঠেনি। সবমিলিয়ে তিনি মাত্র বিশ হাজার টাকার টমোটো বিক্রি করতে পেরেছেন। যে আর্র্থিক ক্ষতির সম্মুখীন তিনি হয়েছেন সেটা কীভাবে পোষাবেন সেই চিন্তায় তিনি এখন অস্থির, দিশেহারা।
একই ঘটনা ঘটেছে যশোর, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লাতেও। মাঠভরা টমেটো পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনও খবর পাওয়া গেছে ঢাকার আশেপাশের ময়মনসিংহ, গাজীপুরের অনেক চাষী একটু ভালো দাম পাওয়ার আশায় নিজেই টমেটো কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসেন। কিন্তু তারাও হতাশ না হয়ে পারেনি। দাম কম হওয়ায় অনেকেই তাই বাজারে টমেটো রেখেই বাড়িতে চলে গেছেন।
বেশিরভাগ চাষীই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে টমেটো চাষ করেছিলেন। ১০ হাজার থেকে গড়ে ১ লক্ষ পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন সবাই খুবই চিন্তিত এই ভেবে যে এই ঋণ তারা কীভাবে শোধ করবেন। কেন এমন হলো? কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন গত বছর ভালো দাম পাওয়াতে এবার নাকি কৃষকরা বেশি করে টমোটো লাগিয়েছিল। কিন্তু সেই তুলনায় চাহিদা না থাকার কারণে এমন একটা নির্মম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে এমনটি হতো না।
জামালপুর, যশোর, রাজবাড়িসহ সব জায়গার চাষীরাই বলেছেন টমেটো সংরক্ষণের জন্যে কোথাও আলাদা হিমাগার নেই। টমেটো সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা থাকলে চাষীদের এত বিপদে পড়তো হতো না। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হতে হতো না। উল্টো অফ সিজনে দিব্যি তারা ভালো দামে টমেটো বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু হিমাগার না থাকার কারণে টমটো এখন মাঠেই পচে যাচ্ছে। আর এই নির্মম দৃশ্যটি কেবলই তাদের হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ করছে।
প্রতিবছরই আমরা দেখছি কৃষকরা একভাবে না একভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেই। গত দুবছর ধরে আলুচাষীরাও ঠিক একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসময়ও বলা হয় অধিক ও অপরিকল্পিত উৎপাদনের কারণেই এমনটি হয়েছে। প্রতিবছরই একের পর এক এ ধরণের ঘটনা ঘটলেও তা নিরসনে কখনই পরিকল্পনাভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
প্রতিবছর আমাদের টমেটোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা কত টন এটি অবশ্যই কৃষি অফিসের জানা বিষয়। সেই হিসেবে আগেই তো কৃষকদের কাছে আগাম বার্তা পৌছে দেওয়া অসম্ভব ছিল না যে, কী পরিমাণ জমিতে টমেটো চাষ করা যাবে। বাজারমূল্য না পেয়ে টমেটো চাষীরা যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলো তা অনেক পরিবারের পক্ষেই সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সবচেয়ে বড় কথা এ বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারক, আমলা, কৃষিবিশেষজ্ঞ সবাই চুপ মেরে বসে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। একমাত্র বাংলাদেশেই বোধ হয় চাহিদা না থাকায় এখনও ফসল নষ্ট হয় ক্ষেতে। আর কোথাও কী এ নজীর আছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এমটিনিউজ২৪.কম এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস