সোহেল এমডি রানা
১.
আজ কলেজ একটু আগে ছুটি হয়েছে। সময়টা কাজে লাগাবেন বলে মিসেস দিলরুবা ভাবলেন। আজ তিনি একা একা ঘুরবেন। কিছু কেনাকাটা করবেন। পছন্দের লেখকের দু'য়েকটা বইও কিনবেন। আজ অনেক দিন পর তার মনে হলো নিজেকে সময় দেয়া হয়না কোনোদিন। তাই আজ তিনি নিজের মত করে সময় কাটাবেন বলে ঠিক করলেন। আজ তার চল্লিশতম জন্মদিনও বটে।
মিসেস দিলরুবা একটি বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। তার সন্তান অনার্স পড়ছে। বাবা মা অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দিয়েছিল। অনার্স পড়া অবস্থায় তার প্রথম ও একমাত্র সন্তান রোজেনের জন্ম হয়। সেই থেকে একদিকে নিজের পড়াশুনা, বাচ্চা মানুষ করা, অপরদিকে শ্বশুড়বাড়ির লোকদের খুশি রেখে সংসার করার এক অনবদ্য জীবন শুরু হয় তার। এই করতে করতে কখন যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে সে যেনো টেরই পেলনা। এতটা সময় তিনি চোখ বাঁধা ঘানিটানা কুলুর বলদের মত চক্রে ঘুরপাক খেয়েছেন শুধু।
২.
আব্দুল গণি খুব সাদামাটা একজন মানুষ। জীবনের বসন্ত দিনগুলোেতে তিনিও আর সবার মত দু'চারটা কবিতা লিখেছিলেন। সে সুবাদে তার ভেতর একটা কবি মনের অস্তিত্ব অনুভূত হলেও তিনি তেমন সাহিত্য বিষয়ক পড়াশুনা করেন না। তিনি তার জীবনের এক সহজ সমীকরণ করে বাংলা সাহিত্যের একজন নারীকে বিয়ে করেন যাতে তার মধ্যে সাহিত্য রস, কাব্যরস এবং রঙিন প্রণয় আখ্যান খুঁজে পান। কিন্তু বিধি বাম। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। তার স্ত্রী দিলরুবা সাহিত্যের মানুষ হলেও তার মধ্যে তিনি কোন সাহিত্য রস খুঁজে পাননি। বরং তার স্ত্রীকে তিনি দেখেছেন কর্কশ এক রমনী হিসেবে যে নিজের লেখা পড়া শেষ করা, নিজে কিছু করা,সন্তান মানুষ করা এসব নিয়েই দিন রাত ব্যস্ত থাকতো। সাহিত্য রস নিয়ে পটের বিবি সাজা তার হয়ে উঠেনি। এতে তিনি এক গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন এবং এক সময় মার্চেন্ডাইজিংয়ের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসায় শুরু করেন। এই ব্যবসায়ে খুব অল্প সময়েই যেমন তিনি মুনাফা লক্ষ্মীর দেখা পেলেন তেমনি তার চারিত্রিক অধোপতন শুরু হতে লাগলো। তিনি প্রায়ই রাতে বাসায় ফিরতেন না। তার সুন্দরী পিএসকে বলতেন -"আজ তোমার নাইট ডিউটি আছে। পি এম সাহেবকে বল রাতে এক শিফট ওভার টাইম করাতে।" নিডি পরিবারের দেহ সর্বস্ব মেয়েটি ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক মেখে টানটান জামা পড়ে গণি সাহেবকে এই বলে সন্তুষ্ট করতেন - "সব ওকে আছে স্যার।" এভাবেই উদীয়মান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আব্দুল গণির সাথে দিলরুবার দূরত্ব বাড়তে থাকে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে রোজেনের সপ্তম জন্মদিনে। একমাত্র ছেলের জন্মদিনে পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকায় দিলরুবা ছুটে যায় গণির অফিসে। এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হবে তিনি কী করে জানবেন। দিলরুবা অফিস থেকে নিরাশ হয়ে যখন ফিরছিলেন তখন তিনি বারবার ভাবছিলেন কেন শুধু তার সাথেই ভাগ্য প্রতারণা করে। স্বামী, শ্বশুড়- শ্বাশুড়ির সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে তাকে পড়াশুনা শেষ করতে হয়েছে। আজকের এই চাকুরিটাতে পরিবারের সবার অমতে যোগদান করেছিলেন। আজ স্বামী তাকে বাদ দিয়ে একটা নতুন সংসার শুরু করেছে তারই প্রতিষ্ঠানের সবচে সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে! নিজের সন্তানের কথাটা ভাবল না একবার?
মানুষ সব পারে। না, অমানুষেরাই সব পারে। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যে বাবার বাড়ি থাকা অবস্থায় মিসেস দিলরুবা ডিভোর্স লেটার রিসিভ করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার একটানা জীবনের পেছনে ছুটে বেড়ানো। রোজেনকে মানুষ করাই তিনি তার একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
৩.
আজ তিনি শহরের যে বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়েছেন তার অদূরেই দেখলেন পাশের কফি শপে তার ছেলে রোজেন একটা মেয়ে নিয়ে আইস কফি পান করছে। রোজেনের ঠোঁটে কফির ফেনা লেগে থাকায় মেয়েটা অদ্ভূত এক হাসি হেসে তার টিস্যু দিয়ে তা মুছে দিল। মেয়েটা অনেক সুন্দরী। দেখে মনে হয় কোন অভিজাত ঘরের হবে। চেহারায় একটা ব্যক্তিত্বেরর জ্যোতি পরিস্ফুটিত হচ্ছে। তাদের আচরণে মনে হয় একে অপরকে ভালবাসে। মিসেস দিলরুবা ভাবেন তার ছেলে এত বড় হয়ে গেছে! তার টেক- কেয়ার করার মত একজন মানুষও আছে। সময় কীভাবে চলে যায়! সংসার নামের যজ্ঞ সমাপন করতে গিয়ে কখনো ভাবা হয়নি ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে তাদের পৃথিবীটা আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। ওদের নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়। আমরা কী সহসা তা ভাবি? আমরা কী তার মূল্যায়ন করি?
কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের প্রতি মিসেস দিলরুবার খুবই নেতিবাচক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে- "ওরা রূপের বিনিময়ে সব করতে পারে।" তবে কী তার সন্তান তার থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাবে? রোজেন যদি এই মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলে তবে কী তিনি শ্বাশুড়ি হিসেবে তার শ্বাশুড়ির মতই আচরণ করবেন মেয়েটার প্রতি? হয়তো হ্যাঁ অথবা রোজেন কোন চাকুরি নিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে কোন ফ্ল্যাটে সুখে শান্তিতে মাকে ছাড়াই বসবাস করবেন? তিনি ভালবাসা বা অবহেলা করার সুযোগই পাবেন না হয়তো।
এসব ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায় মিসেস দিলরুবার।
তিনি সেলিনা হোসেনের "কালকেতু ও ফুল্লরা" বইটি কিনে দোকান থেকে বের হবার সময় দেখলেন রোজেন বাইকে উঠে স্টার্ট দেবার পর মেয়েটি সাবধানে বাইকে বসলো এবং নিজের জামা কাপড় সাবধানতার সাথে গুছিয়ে নিয়ে রোজেনকে তার জীবনের নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে জড়িয়ে ধরলো। বাইকটি একরাশ ধূলি উড়িয়ে চলে গেলো। মিসেস দিলরুবার সকল ভাবনা যেনো সেই ধূলোর সাথে মিশে রাস্তার মত বুক প্রশস্ত করে গন্তব্যের প্রতীক্ষায় রইল। ১৬/৩/১৮
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস