গত বছরের একটি ঘটনা।
মতিঝিল থেকে ফার্মগেট যাবো একটা জরুরী কাজে । বাসে উঠে মোবাইলে ইন্টারনেটে গুতাগুতি করতেছিলাম তো একটু সামনে গিয়ে এক ভদ্রলোক উঠে আমার পাশে বসলো । খেয়াল করলাম সে কিছুক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে কিংবা আমার মোবাইলের দিকে।
মেজাজতো পুরাই খারাপ হতে লাগলো । সহ্য করতে না পেরে মোবাইলটা প্যান্টে ঢুকিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম তাও ট্যারা চোখ দিয়ে দেখলাম সে তবুও আমার দিকে তাকাচ্ছে।
একটুপর জিজ্ঞাস করেই বসলো তোমার নাম কি বাবা ?
জি, আমি চয়ন।
কোথায় যাবা?
ফার্মগেট। আপনি ?
উত্তরা।
আমার ছেলের নাম রুমেল। ও দেখতে ঠিক তোমার মত ছিল।
আমি : ছিল মানে?
সে : ও গতবছর মারা গেছে।
আমি : কিভাবে ?
সে : আর বলোনা বাবা (আবেগ আপ্লুত ) । আমার আদরের একটি মাত্র ছেলে ছিল। ৩ বছর আগে ভর্তি করে দিয়েছিলাম ঢাকায় । অনেক সপ্ন ছিল ওকে নিয়ে এই গরীব বাবার।
কিন্তু ছেলেটা ঢাকায় এসে নষ্ট হয়ে গেল। কলেজের সব খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়েছিল। সারাদিন ঘুরতো, রাতে-বিরাতে খারাপ জায়গায় যেতো, নেশা করতো।
আমি দেখলাম লোকটির চোখে পানির বন্যা গড়িয়ে পড়ছে। কথা আটকিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম আপনি জানলেন কি করে?
সে: ওর বন্ধুরা বলেছে।
গত বছর ইন্টার পরীক্ষায় ও ফেল করে। ওর সেই খারাপ ছেলেবন্ধুরা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলেও। ও আমাকে বলেনি কিছু। আত্নহত্যা করে।
আমি এই ব্যাপারে আর আগালাম না। ওনার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু সে এবার কেঁদেই বলে উঠলো, ওর মা আর আগের মত নেই।
পাগল হয়ে গেছে। সারাদিন ওর নাম জপ করে। আমি হার্টের রুগী বাবা। এতকিছু সামলাতে পারিনা। এত কষ্ট আর সহ্য হয়না। কলেজ কতৃপক্ষের কাছ থেকে পরে জানতে পারি ওর রেজাল্ট ভুল আসছিল।
১ বিষয়ে ওর ফেল আসছিল। কিন্তু ও পাশ করছিল ঐ বিষয়ে । ওর কেন এই মা-বাবার কথা মনে পরেনি। আমরাকি ওর পর ছিলাম। শুধুতো রেজাল্ট সব না। মা-বাবার কাছে তার সন্তানই সবচেয়ে বড়।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, আংকেল উত্তরা এসে গেছেন । ওহ আচ্ছা বাবা আমি এতো ভালো চিনিনা ঢাকা । আচ্ছা বাবা আমি যাই, তুমি আমার ছেলের মত, তাই তোমাকে সব বললাম। কিছু মনে করোনা। তিনি নেমে গেলেন।
বাস একটু এগোতে আমার নিজের মনে পরলো আমিতো ফার্মগেট কত আগে পার হয়ে গেছি। আসলে তার কথার আবেগ আর মায়ায় আমি নিজেই হারায় গেছিলাম।
তড়িঘড়ি করে নামলাম। নামিয়ে তাও লোকটিকে দেখলাম আশে-পাশে। নাহ খুঁজে পেলাম না। পরে আবার ফার্মগেটের বাসে উঠলাম।এবার ভাবলাম। এমন মা-বাবা হয়তো আরো অনেক আছে ।
যারা মনের দিক থেকে মরে গেলেও শারীরিক দিক থেকে হয়তো বেঁচে আছে। কিন্তু তবু তারা নিজের সন্তানকে অসীম ভালোবেসে যায় কোন কিছু পাবার আশায় কিংবা নিরাশায় ।
দুনিয়ার সবাই সবাইকে ছেড়ে চলে যায় । কিন্তু সুখে-দুখে এই মা-বাবাই আমাদের পাশে থাকে । আর ক্ষেত্রবিশেষে অন্যরা সব দুধের মাছি ।
লেখকঃ অদৃশ্য চয়ন ।