'ইশ! কত্তখানি কেটে গেছে!' আমি চোখ মুখ কুঁচকে বুড়ো আঙ্গুলটা চেপে ধরলাম। ফোটা ফোটা রক্ত পড়ছে। শান্তা অনেকটুকু টিস্যু একবারে চেপে ধরলো কাটার উপর। নিমিষে লাল হয়ে গেল সেটা।
'যথেষ্ঠ হয়েছে, আর লাগবে না। এটা চেপে ধরে বসো ।
আমি ধুয়ে দিচ্ছি' কাটা অংশটুকু ডেটল দিয়ে ধুয়ে শক্ত করে ওয়ান টাইম ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিল শান্তা। আমি মুখ গোমড়া করে বসে বসে টিভি দেখতে লাগলাম।
আজ শুক্রবার। আগে থেকেই প্ল্যান ছিল, আজকে শান্তা কিছু স্পেশাল ডিস করবে, কিচেনে তাকে হেল্প করবো আমি। শুরুতেই পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে বিপত্তি। ছুড়িটা এত ধারালো, আমার কোনো ধারনাই ছিল না।
নামাজের আগ পর্যন্ত টিভিতে খবর আর খেলা দেখেই কাটালাম। ফাঁকে ফাঁকে পেপারও পড়লাম। কাছের একটা মুসলিম কমিউনিটি মসজিদে নামজ পড়ে এসে দেখি ডাইনিং টেবিলে শান্তা বসে আছে। ঘ্রাণে ম ম করছে পুরো বাসা।
টেবিলে খাবার সাজিয়ে শান্তার এই চুপচাপ বসে থাকার দৃশ্যটার মধ্যে কি জানি একটা ছিল, নিজেকে হঠাৎ বড় সৌভাগ্যবান মনে হতে থাকে।
দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিছানায় গড়িয়ে নেয়ার অভ্যাস আমার। শান্তা কখনই দিনের বেলা ঘুমায় না। সে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ সে ঘুরে বললো, 'আরিফ, আজকে বিকেলে কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।'
আমি বললাম, 'হুম' শান্তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, 'ঘুমিও না, প্লিজ' আমি পাশ ফিরতে ফিরতে বললাম, 'ডাক দিলেই উঠে যাব, সমস্যা নেই' ।
ডাক্তারের চেম্বারে কড়া একটা এয়ারফ্রেশনারের ঘ্রাণ। আমার মাথা ধরে গেছে। আমি ভ্রু কুঁচকে ব্যাথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছি। শান্তা ভাবলেসহীন মুখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার রিপোর্ট গুলো খামে ভরে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
"আই এম রিয়েলি ভেরি সরি, মিস্টার এন্ড মিসেস রহামান"
আমি শুকনো একটা হাসি দিলাম। না, এই আফ্রিকান অ্যামিরিকান ডাক্তার মোটেও দুঃখিত নয়। প্রতিদিন অসংখ্যবার সে মানুষকে নানা রকম দুঃসংবাদ দিতে অভ্যস্ত।
আসার পথে শান্তা কে নিয়ে সাব অ্যামেরিকান হাইওয়েতে লংড্রাইভে চলে এসেছি। হিল ট্র্যাকের উপর মসৃণ রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে দূরের রাতের নিওইয়র্কের আলো দেখতে অসাধারণ অনুভূতি হয়। শান্তা আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
তার গভীর নিঃশ্বাস রাতের হুহু হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে। গালের উপর তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে অনেক্ষণ হলো। শান্তার মুখের দিকে তাকিয়ে অকারণেই সৃষ্টিকর্তার উপর অভিমান হতে থাকে আমার।
কি হত এই মমতাময়ী নারীকে মা হবার ক্ষমতাটুকু দিলে? শান্তা অসাধারণ একজন মা হত, এটা তুমি জানো, আল্লাহ। কেন, কেন এরকম হয়? আমি ঝাপসা চোখে রাস্তার দিকে মনযোগ দেবার চেষ্টা করতে থাকি।
লেখকঃ আসিফ উর রহমান ।