আমার বয়স তখন মাত্র ৮ বছর, মায়ের জন্য আবারো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা হল। সেদিন, খুব সম্ভবত হারিকেনের আলোয় পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ আর সময় ইনভেস্ট করছিলাম।
কানের নিচে এরকম একটা সংবাদ শুনে মনে হল মায়ের কোলে আমার যে আসন রক্ষিত আছে তা ক্ষমতাচ্যুত হবার বিদায় ঘণ্টা বাজতে আর সময় বেশি নেই। বয়স কম, তবুও মনে মনে ভাবছিলাম 'মা' হয়তো এবারো সম্মতি দিবে না?
পাত্র লন্ডন প্রবাসী, আগের স্ত্রী মারা গেছেন এক সন্তান রেখে। সন্তানের দায়িত্ব বোঝে নেবার জন্য সন্তান আছে এরকম বিবাহিত একজন ভালো মানুষ তাকে খুঁজে পেতেই হবে।
৯১’ সনে বাংলাদেশে হয়তো ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব একটা দুস্কর ব্যাপার ছিল না তাছাড়া পাত্র লন্ডন থাকে শুনলে অনেকের-ই টিকিট নিয়ে লম্বা লাইনে দাড়িয়ে থাকতে অসুবিধের কোন কারন ছিল না।
-দেখো, এ প্রস্তাব টি কিন্তু অনেক ভালো
-আমার ছেলের চেয়ে আর ভালো কিছু হতে পারেনা।
-সুযোগ বারবার আসেনা, তুমি পেয়ে নষ্ট করছো?
-কিসের সুযোগ, আমার প্রয়োজন নেই, আমার ছেলে আছে।
-দেখো, লন্ডন গেলে তোমার ছেলেরও টাকা পয়সার অভাব হবে না।
-ও মানুষ হবে না, মানুষ হলে টাকা পয়সা ওর কাছেই আসবে।
-তাহলে এভাবে নিজে কষ্ট করো, ছেলেকেও কষ্ট দাও।
-হুম, পরের বাসায় টিউশনি করানো কষ্টের কাজ নয়, সম্মানের ও কাজ।
মা রাজি হলেন না এবারো, আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন, সে কান্না আমি আজো ভুলতে পারিনি, পৃথিবীতে এমন কিছু দেখার জিনিস আছে যা একবার দেখলে আর ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
সেদিন মা অনেক কিছুই বলেছিলেন আমাকে, সেসবের অনেক কিছুই আজ মনে করতে পারিনা আবার অনেক কিছুই সাক্ষী হয়ে আছে শরীরের প্রতিটি লোমের মাঝে, লোম গুলিও দাড়িয়ে স্মরন করিয়ে দেয় যথাযত সময়ে।
স্মৃতি বেঁচে থাকে বর্তমানের মাঝে ভবিষ্যতের রুপ নিয়ে, আজ মায়ের ছেলে সেই লন্ডনে-ই, পড়ালেখা শেষ করে মানুষ হবার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
টাকা পয়সা হয়তো ঠিকই ডিপোজিট হচ্ছে মায়ের কষ্টগুলির একাউন্টে কিন্তু সেই কষ্টগুলি আর চেকবুকে লিখা যায় না, ফেরতও পাওয়া যায় না।
মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবীকে আজ স্বর্গ মনে করে প্রতিটি সন্তান।
লেখক: আরাফাত তানিম ।