রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৭:১৯:৫৫

ভালোবাসায় ব্যর্থ অনিকের আত্মহত্যা !

ভালোবাসায় ব্যর্থ অনিকের আত্মহত্যা !

পাঠকই লেখক ডেস্ক: 'অনিক, বাবা উঠ। আর কতো ঘুমাবি?'

মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে বিষন্ন নয়নে মায়ের দিকে তাকালো অনিক। ছেলেকে এমনভাবে তাকাতে কিছুটা ভড়কে গেলেন নাসরিন বেগম। কি হলো তার ছেলের?

- কিরে বাবা? কি হয়েছে তোর?

- কই নাতো মা। কিছুই হয়নি।

- মুখটা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন?

- ঘুম থেকে উঠলাম তো তাই এমন দেখাচ্ছে।

- ঘুম থেকে তো তুই প্রতিদিনই উঠিস, কখনও এমন দেখায় নি। গত কয়েকদিন কেমন জানি আজব আজব লাগছে তোকে?

- না মা। কিছুই হয়নি।

- না হলেই ভালো। মুখ ধুয়ে খেতে আয়। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে তোর।

ছেলের রুম থেকে চলে আসলেন নাসরিন বেগম। অনিক যতোই বলুক তার কিছুই হয়নি, উনি এটা মেনে নিতে পারছেন না।

মা রুম থেকে চলে যাওয়ায় বিছানা থেকে নামলো অনিক। জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করলো। মন খারাপ থাকলে প্রকৃতির দৃশ্য দেখে অনিক। এতে তার মন অনেকাংশেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মন আরও খারাপই হতে থাকলো।

অনিকের মন খারাপের কারণ নাবিলার সাথে তার এতোদিনের সম্পর্কের অবসান। গত কিছুদিন যাবৎ ভাঙে ভাঙে করেও ভাঙছিল না। তাই নিজের স্বাভাবিক সত্ত্বাটা হারিয়ে ফেলেছিল অনিক। গতরাতে তা একদম পুরোপুরি ভেঙে গেছে সম্পর্কটা। নিজেকে পুরোপুরি শুন্য মনে হচ্ছে এখন অনিকের। নাবিলাকে ছাড়া তার পক্ষে একমূহুর্তও সময় কাটানো সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতেই আর থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না অনিকের।

ক্লাসের জন্য তৈরি হলো অনিক। বেরিয়ে যাবে এমন সময় পিছন থেকে ডাক শুনলো।

- কিরে বাবা, নাস্তা করবি না?

- না মা, ইচ্ছে করছে না এখন।

- নাস্তা করতে ইচ্ছে করছে না -এ কেমন কথা?

- এমনই কথা। (নির্বিকার উত্তর অনিকের)

- (ছেলের কথায় অনেকটা ভড়কে গেছেন) বাবা, সত্যি করে বলতো তোর কি হয়েছে?

- কই মা, নাতো কিছুই হয়নি।

কথা আর না বাড়িয়ে চলে গেলো অনিক। মায়ের সাথে বেশিক্ষণ মিথ্যে বলতে পারে না সে।

ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রাস্তায় হাঁটছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, নাবিলাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে সে থাকতে পারবে না, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। আত্নহত্যার পথ বেছে নিল। কিভাবে করবে সে এই কাজ। দাঁড়িয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ।

'ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপ দিবো, না সাতার জানি। বিল্ডিং এর ছাঁদ থেকে লাফ দিব, না মাটিতে পড়তে অনেক সময় লাগবে। ট্রেনে কাঁটা পড়াই ভালো, উলটো ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো, পিছন থেকে এসে ধাক্কা দিবে ট্রেন, মৃত্যু হতেও বেশি টাইম লাগবে না।'

পিছন ঘুরে এলাকাটা একবার দেখে নিল অনিক। কতো দিনের চেনা এলাকাটা, শেষবারের মতো দেখছে। অনেক কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার এলাকাটার সাথে। কিছুক্ষণের মাঝে সে নিজেও এলাকাটার স্মৃতি হয়ে যাবে। আর বেশি দেরি করলো না অনিক, প্রস্থান করলো এলাকা থেকে।

রেললাইনের ওপর বসে আছে অনিক। অস্থির ভাবে সিগারেট টানছে। ট্রেনের নিচে কাটা পড়ার জন্য নির্জন একটা এলাকা বেছে নিয়েছে। তার বাসা থেকে অনেক দূরে। এদিকটায় জনমানবের চলাচল খুব কদাচিৎ। এমন জায়গায় দাঁড়ানোর কারণ কেউ এসে তাকে বাঁধা দিবে না। সুইসাইডের জন্য আদর্শ একটা জায়গা।

এমনিতে খুব একটা ধূমপান না করলেও এখন প্রায় অনেকগুলো সিগারেট টেনে ফেলেছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখছে, ট্রেন স্টেশন থেকে ছেড়েছে। এই জায়গাটায় আসতে আরও প্রায় আধঘণ্টার মতো লাগবে। সুন্দর এই ধরণীতে অনিকের অস্তিত্ব আর আধঘণ্টা।

পাঁচ মিনিট পর অনিক দেখতে পেল সামান্য দূরেই রেলট্র্যাকের উপর একটি মেয়ে বসে আছে। জনমানব শুন্য জায়গায় একটা মেয়েকে দেখে কিছুটা অবাক হলো অনিক। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবছে। মেয়েটির এখানে আসার কারণ কি? সেও কি কোনো কারণে তারই মতো আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মেয়েটির সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো অনিক।

- কি ব্যাপার মিস? এই নির্জন জায়গায় কেন আপনি?

- জায়গাটা নির্জন?

- হ্যাঁ, নির্জন। এখানে তো কেউ আসে না খুব একটা।

- তাহলে আপনি কি? নির্জনদের একজন?

- না।

- তাহলে আপনি থাকার পরও এই এলাকায় নির্জন কিভাবে?

এমন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই অনিকের। সে যখন এসেছিল, তখন কেউ ছিল না এই জায়গায়, তখন নির্জন এলাকা বলা যেতো। কিন্তু মেয়েটি যখন এসেছে, তার আগে থেকেই সে একজন হয়ে জায়গাটায় ছিল। তার মানে মেয়েটি নির্জন জায়গায় আসেনি।

- আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি নির্জন জায়গায় আসেন নি। কিন্তু কেন এসেছেন?

- মরতে।

- মানে?

- মানে আত্নহত্যা করতে এসেছি।

- আত্নহত্যা করতে এসেছেন? কিন্তু কেনো?

- দুনিয়াতে আর ভালো লাগছে না তাই।

- আজব তো, দুনিয়াতে ভালো না লাগার কি এমন ঘটলো আপনার সাথে?

- অনেক কিছুই ঘটেছে। আপনাকে কেনো বলতে যাবো?

- আচ্ছা না বলেন। অসুবিধা নেই। (জানে নিজে থেকেই বলবে, তাই আর এতো আগ্রহ দেখালো না)

- সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। (নিজে থেকেই বললো মেয়েটি)

- সে কে?

- আমার… (আমতা আমতা করছে)

- আপনার কি? বয়ফ্রেন্ড?

- হুম।

- তাই আপনিও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?

- হুম

- আপনার বয়ফ্রেন্ড তাহলে তো অনেক ভাগ্যবান।

- কিভাবে?

- এই যে আপনার বয়ফ্রেন্ড আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

- আমার বয়ফ্রেন্ড পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আপনাকে কে বললো?

- এই যে, আপনিই না বললেন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে।

- উফফ! পৃথিবী ছেড়ে যায়নি। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। অন্য মেয়ের সাথে রিলেশন শুরু করেছে।

- ও..! তাহলে তো আপনি অনেক বোকা।

- আমি বোকা! কি বলেন এইসব?

- আপনি তো বোকাই। এমন একজনের জন্য আত্নহত্যা করার চিন্তা করছেন, যে আপনাকে চায়ই না। আপনি আত্মহত্যা করলে তার কি কোন ক্ষতি হবে?

- হ্যাঁ, সে কষ্ট পাবে।

- যদি কষ্ট পেতই তাহলে কি আপনাকে ছেড়ে চলে যেতো?

- (মেয়েটি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল) তাহলে কি করবো আমি?

- ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যান। এমন ছেলের কথা যতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই ভালো। শুধু শুধু আত্নহত্যা করে নিজের বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে আছে!

- (মনে মনে ভাবছে, ছেলেটি ভুল কিছু বলেনি) তাহলে, কি করবো এখন?

- কি করবেন তা পরে ভাবেন। আগে রেললাইন থেকে সড়ে যান, ট্রেন প্রায় এসে গেলো। (ট্রেনের আসার দিকে তাকিয়ে)

- (কিছুটা ইতস্ততা করে) হুম ঠিক বলেছেন।

রেলট্র্যাক থেকে সরে গেলো মেয়েটি। অনিক কিছুটা নির্ভরতা অনুভব করলো। মেয়েটিকে বোকামি করতে দেয়নি। 'কি লাভ এসব আত্নহত্যা করে? মেয়েরা আসলেই অনেক বোকা? অযথা কারণে নিজেকে শেষ করে দেয়ার কোনো মানে আছে?' ভাবনার সাগরে ডুবে গেলো অনিক।

- আপনি কি কারণে এসেছেন এমন জায়গায়?

মেয়েটির প্রশ্নে ভাবনার সাগর থেকে বের হলো অনিক। মনে পড়লো, সেও তো আত্নহত্যাই করতে এসেছিল। মেয়েটির মতো সেও একি বোকামি করতে যাচ্ছিল। নাবিলাও তাকে ছেড়ে আরেকজনের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে গেছে। এমন একটা মেয়ের জন্য সে নিজেকে বিপন্ন করতে চেয়েছিল? যে কখনোই তাকে চায়নি, তার জন্য সে কেনো মারা যাবে? কষ্ট তো তার বাবা-মা ই পাবে। একফোটা কষ্টও তো নাবিলা পাবে না। মেয়েটিকে বুঝাতে যেয়ে সে নিজেও বুঝে ফেললো। আত্নহত্যা করা বোকামি এক ধরনের।

- কি বললেন না তো?

- এসেছিলাম আপনারই মতো কোনো কাজ করতে।

- তাহলে কি করছেন কাজটা?

- জানিনা।

- তাহলে আমাকে এতক্ষণ যাবৎ বুঝালেন কেন?

- হুমম… আচ্ছা চলুন তাহলে। কাজটা করবোই না।

- ভালো ছেলে। (হালকা হেসে)

একসাথে রেললাইন ছেড়ে চলে আসল অনিক ও মেয়েটি। পিছনে গতির সাথে চলন্ত ট্রেনের বাতাস কাঁটার শব্দ শুনতে পেল দুজনই।

- কোথায় আপনার বাসা? রিকশা ঠিক করে দেই?

বাসার ঠিকানা বললো মেয়েটি। অনিক অবাক হয়ে গেলো মেয়েটার বাসা তার এলাকাতেই। এতোদূর এসেছিল আত্নহত্যা করতে? আর মেয়েটিকে সে কখনও দেখেনি কেনো? এটার উত্তর হতে পারে সে এলাকায় খুব কম সময় কাঁটায়, যার কারণেই চিনে না ভালো করে।

- এতোদূর এসেছিলেন শুধু আত্নহত্যা করতে?

- না, আরেকটা কাজও ছিল।

- এতোদূরে কি কাজ?

- আমি সাইকোলোজির স্টুডেন্ট তো তাই।

- মানে? বুঝলাম না কিছুই?

- আপনি বুঝবেনও না।

- বুঝিয়ে বলুন?

- শুনুন তাহলে। সাইকোলোজির স্টুডেন্ট আমি, মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি। কয়েকদিন যাবৎ এক মহিলা তার ছেলের হঠাৎ বদলে যাওয়া আচরণ নিয়ে বলছিল। আজ সকালে ভার্সিটি উদ্দেশ্যে বের হবো, তখন ঐ মহিলাটা আমাকে ফোন দিয়ে বললো তার ছেলে নাকি সকালে নাস্তা না করেই বের হয়েছে, কেমন যেন অন্যমনস্ক ছিল। আমি উনাকে বললাম যে, উনার ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করবো।

কিন্তু বুঝতে পারলাম না যে কিভাবে বুঝাবো। বাসা থেকে বের হলাম, দেখি ছেলেটা দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। পরে যখন ছেলেটা হাঁটা শুরু করলো, তখন তার পিছু নিয়েই আসলাম এখানে।

- (পুরোই বিস্ময়ের ঘোরে) মানে ছেলেটা আমি? আপনি আত্নহত্যা করতে আসেন নি, আমি যাতে পাগলামি না করি তার জন্যেই এসেছিলেন?

- অনেকটা তাই।

- কিন্তু আপনি তো আমাকে বুঝাননি। উলটো আমিই তো বুঝালাম আপনাকে।

- অনেক কিছুই আছে, মানুষ নিজে বুঝেনা কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অন্যকে ভালো বুঝাতে পারে। তাই আপনার সাথে ঘটনাটা আমার বলে চালিয়ে দিলাম।

- আমার ঘটনা তো আমি কাউকে বলিনি, তাহলে আপনি জানলেন কিভাবে?

- অনেকটা আন্দাজে। আপনাদের ফ্যামিলিগত কোন অসচ্ছলতা নেই, ছাত্র হিসেবেও ভালো অবস্থানে আছেন। তার মানে আপনার আচরণ বদলে যাওয়ার জন্য ঐসব দায়ী নয়। বাকী থাকে প্রেমে ধোঁকা খাওয়া।

- কিভাবে বুঝলেন এটাতে কাজ হবে?

- আপনার সম্পর্কে যতোটা শুনেছি, আপনি বাস্তববাদী ছেলে। চোখের সামনে কাউকে এমন পাগলাটে কিছু করতে দেখলে আপনি তাকে থামাবেনই। আর পরে নিজের পাগলামীটা থেকেও সড়ে আসবেন ।

অনিক মেয়েটির বুদ্ধিমত্তার তারিফ করছে মনে মনে। কিভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো কাজটা করিয়ে নিলো তাকে দিয়ে।

- কি চলুন? নাকি আবার ট্রেনে নিচে যাবেন?

- কোথায় যাবো?

- বাসায় যাবেন। আপনার জন্য আমিও সকালে নাস্তা করতে পারিনি। এখন বাসায় গিয়ে আমার ফি হিসেবে আপনার মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাবো।

খাবারের কথা শোনায় পেটে ভিতর কেমন যেন মোচড় দিল অনিকের।

- কি হলো এখনও দাঁড়িয়ে কেন? চলুন?

- হ্যাঁ চলুন। আমার পাগলামী সারালেন, এতোক্ষণ কথাও বললেন, আপনার নামটা কিন্তু এখনও বললেন না।

- (মৃদু হেসে) অনন্যা।

লেখিকা: অপ্সরা তমা ।

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে