পার্থ প্রতিম চন্দ্র : পুরো একটা বছর হয়ে গেল MH370 বিমানের কোনও খোঁজ মিলল না। আস্তে আস্তে স্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে মাঝ আকাশে হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বেজিংগামী যাত্রীবিমান MH370। উদ্ধারকারী দল আশা ছেড়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারও প্রায় ধরেই নিয়েছে আর কোনও দিন পাওয়া যাবে না। কিন্তু সবাই ভুলে যেতে বসলেও ভোলেনি MH370 বিমানের যাত্রী আর বিমানকর্মীদের পরিবারের লোকেরা।
এক বছর পর হারিয়ে যাওয়া বিমানের এক যাত্রীর ১০ বছরের ছেলে চিঠি লিখেছে তার বাবাকে। সেই চিঠিটাই এই ব্লগে লিখলাম।
প্রিয় বাবা,
বাবা পুরো একটা বছর কেটে গেল তবু তুমি এলে না। তবে জানো তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমি একটুও ক্লান্ত হয়নি। কেন জানো! আসলে আমার বন্ধুদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। ওরা ওদের বাড়ির লোকের কাছে শুনে আমায় বলেছে, তুমি নাকি আর কোনও দিন ফিরবে না কারণ নাকি তোমার খোঁজ আর কোনও দিন পাওয়া যাবে না।ওদের কথা শুনে আমার হাসিই পেয়ে গিয়েছিল। আমি জানি তুমি ফিরবে, ফিরবে , ফিরবে। তুমি যে প্লেনে ছিলে সেই MH370-টা কোথাও না কোথাও নিশ্চই আছে।
তুমি আমায় একটা গল্প বলেছিলে মনে আছে! গল্পের শেষে বলেছিলে, তুমিও ওই গল্পের নায়কের মত একটা দেশ খুঁজে বের করবে। জানি ওমন একটা দেশ খুঁজতেই তুমি গিয়েছ। তোমার সেদিন হয়তো প্লেনেই সবাই ঠিক করলে এমন একটা দেশ খুঁজবে যেখানে কোনও বাজে লোক থাকে না, যেখানে কালো সাদা লোকেদের আলাদা করে দেওয়া হয় না, যেখানে গরীব-বড়লোকে বলে কিছু নেই। সেই রকমই কোনও দেশ হয়তো তোমরা পেয়ে গিয়েছো।
জানো ক'দিন আগেই আমাদের স্কুলের সেই অডিটিরিয়ামে একটা অনুষ্ঠান হল তোমাকে আর প্লেনটাকে নিয়ে (অবশ্য এরকম অনুষ্ঠানে এই এক বছর অনেক হয়েছে, আমায় অবশ্য ওগুলোতে মা যেতে দেয়নি)। অনেক লোকে তোমায় আর প্লেনটাকে নিয়ে অনেক কথা বলল। সবটা আমি বুঝতে পারিনি, তবে যেটুকু বুঝলাম সেটাতে পরিষ্কার, ওরা শুধু বিজ্ঞান আর বই পড়া জিনিসগুলোই বোঝে। কিন্তু নিখোঁজ কোনও কিছুর জিনিস যদি বই পরে বলে দেওয়া যেত তাহলে তো বারমুডা ট্র্যাইঙ্গেল, গড এসব কিছুই থাকত না। অনুষ্ঠানের শেষে মাকে একটা মূর্তি দেওয়া হল, মা কাপড় দিয়ে চোখটা মুছে ছিল। মাকে কিছু বলতে খুব জোর করল ওরা। মা কিছু বলতে পারল না।
আমায় দেখে সবাই মুখ দিয়ে এমন একটা আওয়াজ করতে লাগল যেন আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মাইকটা আমার সামনে দিলে আমি বলতাম, প্লেনটা হারিয়ে যায়নি, খুঁজতে গেছে। খুঁজতে গেছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা, আর আন্তরিকতাকে। এ কথাটা কেন মনে হল জানো? তুমি চলে যাওয়ার পর টিভিতে যতবার তোমার আর হারিয়ে যাওয়া প্লেনটার কথা দেখিয়েছে ততবার বাড়ির ফোনটা বেজেছে, কলিংবেলে আওয়াজ হয়েছে। সবাই এসে মাথায় হাতও বুলিয়েছে। কিন্তু তুমি শিখিয়েছিলে না, আসল ভালবাসা আর মেকি ভালবাসার ফারাক কীভাবে ধরা যায় সেই পদ্ধতিটা। তাতে করে বুঝে গেছি ওরা ঠিক ভালবাসে না। তুমি থাকলে তুমিও এমনটাই ভাবতে....
দেখো তোমায় আর একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম তুমি চলে যাওয়ার পর মা ক টা দিন কিচ্ছু খায়নি। টিভিতে, কাগজে, ম্যাগাজিনে কটা দিন শুধু তোমার আর ওই MH370 প্লেনটার কথা। তারপর আস্তে আস্তে সবাই ভুলে গেল। মা একটা চাকরি পেল। মাঝে আরও একটা প্লেন হারিয়ে গেছিল, পরে পাওয়া গেল ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবস্থায়। তখন আমাদের বাড়ির সামনে ক দিন ক্যামেরার ভিড় ছিল, তোমার কথা হচ্ছিল, মা ইন্টারভিউও দিল। তখন ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এবার আসবে। কিন্তু না...
ওই প্লেনের খোঁজ পাওয়ার পর মা-ও বলতে শুরু করল তোমাদের প্লেনটাও হয়তো কোথাও ভেঙে পড়েছে। আমি মায়ের সঙ্গে তর্ক করেছিলাম। মা তখন চুপ করেছিল। ক দিন আগে টিভিতে বলেছিল, তোমাদের প্লেনের ব্যাটারি না কী যেন একটা পাওয়া গিয়েছে। এখন আমার ওসব ভাল লাগে না, বিশ্বাসও হয় না। প্রথম প্রথম যখন কোনও একটা মহাসাগরে তোমাদের প্লেনের খোঁজ চলছিল তখন একদিন শুনছিলাম এই পাওয়া যাবে, এই ব্ল্যাক বক্স সাড়া দিয়েছে...ও মা তারপর দেখলাম ওসব কিচ্ছু না। সবাই আস্তে আস্তে ভুলে গেল। জানি সবাই ভুলে যাবে, শুধু আমি ভুলব না।
স্কুলে একটা রচনা লিখতে দিয়েছিল তুমি কী হতে চাও এটা নিয়ে। আমি লিখেছিলাম পাইলট হতে চাই। কেন জানো! তোমায় প্লেনে করে খুঁজতে যাবো তাই। এখন খুব মন দিয়ে পড়ছি। পাইলট হতেই হবে। আমি এখন আর কাগজের প্লেন বানাই না। এখন ওসব খেলা আর ভাল লাগে না। তোমায় একটা মিথ্যা কথা বলেছি। চিঠির শুরুতে বলেছিলাম না, বন্ধুরা তুমি আসবে না বললে আমার হাসি পায়, ওটা মিথ্যে কথা। আসলে আমার কান্না পায়। স্কুলের স্যার বলেছিল, ওত বড় একটা প্লেন কখনও এতদিন নিখোঁজ থাকতে পারে না। টিভিতে র্যাডার না কি বলে একটা জিনিসের কথা বলে বুঝিয়ে বলেছিল কেউ তোমাদের প্লেনটা বন্দুক দিয়ে নামিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। সব কথা শুনে আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। মনের জোরটা কমে আসছে বোধহয়। সব কেমন যেন গুলিয়ে আসছে। আগে দেখতাম তুমি প্লেনটা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা এইয়া বড় সাগরের সামনে স্নান করতে নামছো। এখন আর ওটা দেখতে পাই না। এখন ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্নে মাঝে মাঝে শুনতে পাই আসবে না, ধ্বংস হয়ে গেছে, সবাই মারা গেছে। বাবা তুমি ফিরে এসো, এসো প্লিজ। আসার সময় কিচ্ছু আনতে হবে না।
ঠিকানা জানি না তাই লেখাটা নৌকা বানিয়ে জলে ছেড়ে দিলাম। আমি জানি লেখাটা ভেসে ভেসে তোমার কাছে যাবে। তুমি পড়ে নিজের কাছে রেখে দিয়ো। আর হ্যাঁ মাকে বলো না আমি তোমায় চিঠি লিখেছি, তাহলে খুব রেগে যাবে। মা বলে বাবার কথা সব সময় ভাববে না।
ইতি- প্রিন্স
(চিঠিটা পুরোটা কাল্পনিক নয়, ক মাস আগে বিবিসিতে দেখানো এক তথ্যচিত্রে MH370-র এক অস্ট্রেলিয়ান যাত্রীর পরিবারের কথা দেখাতে গিয়ে, এক শিশুর কথা বলা হয়। সেই শিশুর সাক্ষাত্কারে এ ধরনের বেশ কিছু কথা বলা হয়। সেখান থেকেই এই চিঠির বেশ কিছুটা অংশ নেওয়া হয়েছে।)
৪জুন, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন