নাজমুন নাহার : আমি নারী বলে কখনোই নিজেকে ছোট ভাবি না । ভাবি না যে কেন পুরুষ হলাম না । বরং নারী হবার কারণে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি । সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেভাবে গড়েছেন তাতে আমি খুশী । আমার চারপাশের সকল পুরুষই ভালো মানুষ । আমার বাবা,স্বামী, ছেলে, আমার প্রিন্সিপাল স্যার আমার কলিগরা সবাই-ই ভালো এবং বন্ধু বৎসল ।
কিছু অসৎ মানুষ থাকবেই । ভাগ্য ভালো যে তাদের দেখেছি এবং যতটা দেখেছি সেটা প্রকাশ করলাম না। কিন্তু তার চাইতেও যে পাশবিকতা শুরু হয়েছে আজকাল বিষয়টা নিয়ে ভাবছি খুব। কেন এত যৌন নিপীড়ন! অথচ এই ছেলেরাই যখন অন্য দেশে যায় তখন অনেক খোলামেলা মেয়েদের দেখে। যেমন মালয়েশিয়াতে দেখেছি মেয়েরা এত খোলামেলা চলছে। বাংলাদেশের প্রচুর ছেলে তাদের সাথে কাজ করছে। এবং এমন না যে তারা খুব বেশী পড়াশোনা জানা ।
বেশীর ভাগের পড়াশোনার লেভেল মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত অথবা কেউ কেউ পড়াশোনা ক্লাস এইট পর্যন্ত করেছে । যেমন রোজ গার্ডেনে এক ছেলে দেখেছি সে মাত্র এইট পাস। এরা কিন্তু সেখানে সুন্দর কাজ করছে। প্রচুর খোলামেলা ড্রেস পড়ে মেয়েরা চলছে ফিরছে। কই সেখানে তো আমার দেশের ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে না! বরং ভদ্র ব্যবহার করছে। সহযোগিতা করছে ছেলে মেয়ে সকল টুরিস্টকে। কিন্তু এই বাংলাদেশে কেন এটা ঘটছে?
আইনের শিথিলতা হতে পারে একটা কারণ। যেমন আমাদের এখানে যে বাচ্চা মেয়েটা রেপড হলো সে মেয়েটা হয়তো বেঁচে উঠবে অথবা মরে যাবে। বেঁচে গেলে মেয়েটা ঘরে ফিরে আসবে এবং অপরাধী কিছুদিন পরে সদলবলে বুক ফুলিয়ে হাঁটবে।
মেয়েটাই বরং লজ্জা পাবে। তার সাথে এই ঘটনা হবার কারনে। একটা বিভীষিকা নিয়ে বড় হবে এবং দুঃস্বপ্ন সে দিনের পর দিন রাতের পর রাত দেখবে। আর ছেলেগুলো আর একটা রেপ করার জন্য আরো মেয়ে খুঁজে বেড়াবে। তাহলে রেপের ঘটনা কমছে না।
পরিবারে কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধাবোধ না থাকা। মা বাবা সারাদিন ঝগড়া ঝাটি করছে, যে সমাজে থাকছে সেই সমাজে অভাব অভিযোগ হানা হানি ইত্যাদি বিদ্যমান। আবার সেখানে অল্পতেই নারীর উপর পুরুষের চড়াও হওয়া। যেমন কিছু হলেই স্বামী স্ত্রীকে মারতে আসছে। আবার সে অভাব অভিযোগের সমাজ অল্পতেই শিশুর উপর মারধোর করছে। তাই টলারেন্স বা ধৈর্য্যের ব্যপারটি শিশু শেখে না ।
একজন শিশু অপরাধী হয়ে জন্মায় না। কিন্তু এই পরিবেশ তাকে অপরাধী বানায়। অশান্ত পরিবেশ কখনই ভালো মানুষ হবার জন্য অণুকূল না। একজন শিশু যখন রাস্তায় বেড়ে উঠছে মায়া মমতা বিহীন তখন সে জানছেই না ভালোবাসা কি । সে দেখছে প্রতিটা মানুষই নির্দয়। সবাই তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করছে। সে জানছে এটাই পৃথিবী। কিছু শিশু বেড়ে উঠছে স্টেশনে। তার বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহুর্তই জটিল ।
টেম্পুতে হেল্পার দেখেছি প্রায় ৭/৮ বছর বয়সী ছেলে। তাকে পৃথিবী বোঝার আগেই বুঝতে হয় পেটে কিছু দিতে হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যে মানবিক পরিবেশ সে পায়নি সে মানবিকতা সে শিখবে কেমন করে ?
ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার। কেউ ক্লিক করলেই যদি অশ্লীল কিছু পায় এবং সে যদি হয় মাত্র বেড়ে ওঠা কিশোর সে নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এই বয়সটাই এমন যে, সে কারো কথাই শুনতে চায় না। আবার একই সাথে বাসনার ব্যপারেও তার আগ্রাসী হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু না।
এন্টারটেইনমেন্টের জন্য ব্যবস্থা শুধু হিন্দী চটুল গানের সাথে উন্মাতাল না, গান ইত্যাদি । অনেক আগে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরী গড়ার কথা। যে ছেলে শুধু মোবাইলে গান শুনে সময় কাটায়, হিন্দী সিনেমা দেখে সময় কাটায় সে একটু সময় কাটানোর জন্য হলেও লাইব্রেরীতে বসে সে তার অলস মস্তিষ্ককে ব্যবহার করা শিখতো। কেননা সেখানে সে শিক্ষিত হবার সুযোগ পেতো। শুধু পাশ করার জন্য পড়াশোনা নয় মস্তিষ্ককে পরিশুদ্ধ করার জন্যও পড়াশোনা করা দরকার।
পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা যায়। এরপর সেখানে আয়োজন করা যায় কম্পিটিশনের। ছেলেমেয়ে সবার অংশগ্রহণে গড়ে উঠতে পারে একজনের প্রতি আর একজনের সহমর্মিতা , শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। যাতে ছেলেমেয়েরা নাটক, গান, অভিনয়, আবৃত্তির মত সুকুমার বৃত্তিগুলোর চর্চা করতে পারে। অবসর সময় সে শিখবে তার গানের গলাকে আরো কিভাবে শানিত করা যায়, কি করে সুন্দর আবৃত্তি করা যায়, কি করে সুন্দর করে গীটার বাজানো যায় এবং এসব কাজে যথেষ্ট প্রশংসা করা যাতে সে আরো বেশী উৎসাহ পায় এসব ক্রিয়েটিভ কাজে।
এরপর সাহিত্য প্রতিযোগীতার আয়োজন করা যেতে পারে। এসব যে হচ্ছে না যে তা নয়। কিন্তু তৃণমূল থেকে আসতে হবে বিষয়গুলো ।
শুধু নারী বা পুরুষ নয়। সবাই সমান অংশীদার এই দেশের এই সমাজের। কেউ আমরা কাউকে ছাড়া চলতে পারবো না। এই বোধ গড়ে ওঠা দরকার। একই সাথে আইনের কঠিন প্রয়োগে আমার মনে হয় এইসব সমস্যার সমাধান হতে পারে। লেখক : নাজমুন নাহার, কবি ও প্রফেসর
২৫ মে ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন