একটি কালো গোলাপের আত্মকথা
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, সকাল থেকেই আকাশ তার ভয়াবহতা দেখিয়ে যাচ্ছে, চারিদিক অন্ধকারে আবদ্ধ করে দিন কে রাত বানাতে আকাশ যেন অনেক পটু। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলি প্রকৃতির এই খেলা উপভোগ করে চলেছে। আসলে বৃষ্টি কলি অনেক পছন্দ করে, এমন বৃষ্টিতে তার ভীষণ সাধ হয় ছাদে গিয়ে ভিজতে, কিন্তু তার জননীর ভয়ে তা আর হয়ে ওঠে না। কলি তার মাকে অনেক ভঁয় পায়, তবে ভালোও কম বাসে না। কলির দুষ্ট একটা ছোট ভাই আছে, নাম আতিক। ওর সাথেই হেসে খেলে সময় কাটায় কলি।
২০০৯ সাল, কলি সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেছে। কলির মা ওকে শিল্পকলা একাডেমীতে ভর্তি করাল নাচ শিখাবার জন্যে। নিয়মিতই কলি নাচের ক্লাস করত। একদিন এক যুবক কলিকে ডেকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করল। সাথে সাথেই কলি ভয়ে দৌড়ে পালাল। আসলে কলি কখনো কোন ছেলেদের সাথে মিশে নি। তাই ওর এতো ভয়। পরবর্তীতে ছেলেটি সরাসরি কলির মায়ের কাছে গিয়ে কলির সাথে নিজের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কলির মা ব্যপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয় এবং ছেলেটির অভিভাবকদের সাথে কথা বলার জন্যে মত প্রকাশ করেন।
ছেলেটির নাম এরফান। বাবা দেশের বাহিরে থাকে। ছেলেটি কলির মাকে আশ্বাস দিলেন যে তার বাবা এক মাসের মধ্যেই ঢাকায় আসবেন এবং বিয়ের সকল কিছু ফাইনাল করবেন।
কলি এখন বয়:সন্ধিকালের অন্তিম মুহূর্তে অবস্থান করছে। ছোট বেলা থেকেই ও সব সময় একা একা সময় কাটাত আর পড়ালেখা নিয়ে থাকত। তবে এরফানকে ওর ভালো লেগেছে। এরফান ওর খুব যত্ন নেয়। প্রায় ওকে বাসায় এসে নিজের হাতে খাবার খাওয়াইয়ে দেয়। এরফানের বাসায় গিয়ে কলির মা প্রায়ই এরফানের মায়ের সাথে আড্ডা দেয়, তবে কলিকে এরফানের মা কখনও দেখে নি। বলেছে একবারে ওর বাবার সাথে দেখবে।
কলি বিভিন্ন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এরফানকে নিয়ে। বিয়ের পর কোথায় ঘুরবে, বাচ্চাদের নাম কি রাখবে ইত্যাদি এরকম অনেক রকমের স্বপ্নই।
এরফানের বাবা দেশে ফিরল। একটি দিন ঠিক করে এরফানের বাবা-মা কলিকে দেখতে আসলো। কলির পরিবার খুব ভালোভাবেই তাদের অতিথি আপ্যায়ন করল।
পরদিন, সকালে এরফানের মায়ের ফোন...
-হ্যালো!
-হ্যাঁ আপা বলেন।
-আসলে কি করে যে বলব বুঝতে পারছিনা।
-কেন? কি হয়েছে আপা, খুলে বলুন।
-আসলে এরফানের বাবার কলিকে পছন্দ হয়নি। ওর বাবা এই বিয়েতে সম্মতি দেন নি। সুতরাং......
ফোনটা এতক্ষণে রেখে দিয়েছে কলির মা। ওদিকে এরফান ওর মাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে ওর মা উত্তর দেয়
-দেখো এরফান, এরকম কালো মেয়ের সাথে আমরা তোমার বিয়ে দিতে পারব না। তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার বাবার অনেক ইচ্ছা কোন এক পরীর মতন মেয়ের সাথেই তোমার বিয়ে হবে। সুতরাং মেয়েটাকে ভুলে যাও।
এরফান কখনও বাবা-মায়ের অবাধ্য হয় নি। এবারও হতে পারবে না। এমনটাই কলির মোবাইলে ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে দিল এরফান, সাথে কলিকে তার বাবার অপছন্দ হওয়ার কারণও।
অজস্র ফোঁটা চোখের জল ভাসাচ্ছে কলি নামের সেই মিষ্টি মেয়েটা যে কিছুক্ষণ আগে জানতে পারল শুধু মাত্র কালো হওয়ার কারণে তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষাই খুজে পাচ্ছে না কলির মা।
শুধু মাত্র গায়ের রঙই কি সব? অন্তরের সৌন্দর্যের কি কোন দাম নেই? আচ্ছা ফর্সা মেয়েরা যদি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট হয় তাহলে কি কালো মেয়েদেরকে অন্য কেউ সৃষ্টি করেছে? আর যদি একজনই দুজনকে সৃষ্টি করে থাকে তাহলে কেন এই ভেদাভেদ?
রেজাল্ট বের হল। অল্পের জন্যে এ প্লাস পায়নি কলি। সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না হওয়ায় অবশেষে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল কলি।
সবার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে ও। কাউকে কখনও কটু কথা বলে না, কারো সামনে মাথা উঁচু করে কথাও বলে না। কারন উঁচু করে কোন কথা বলতে গেলেই কলির মনে হয় ওর গায়ের রঙের কথা। তখন ওর মনে হয় কালো মেয়েদের হয়তো সব জায়গায় ছোট হয়েই থাকতে হয়, চুপ হয়েই থাকতে হয়।
বাসে করে প্রতিদিন ভার্সিটি আশা যাওয়া করে কলি। একটি ছেলেকে কলি প্রায়ই দেখতে পায়। ওর পিছে পিছেই বাসে উঠে। তার পর ও নেমে পরলে ছেলেটাও নেমে যায়। তবে এর বেশি কখনই কিছু হয়নি।
দেখতে দেখতে ১ম সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ। পুরো ক্লাসে ফার্স্ট হয় কলি। কলির মা-বাবার খুশি ছিল বাঁধিয়ে রাখার মত। আর খুশি হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। অনেক দিন পর তাদের একমাত্র মেয়েটাও যে অনেক খুশি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ম্যাগাজিন তৈরি করা হবে। প্রত্যেক ক্লাসের প্রথম হওয়া ছাত্র-ছাত্রী-দের নিয়ে। কলি খুবই এক্সাইটেড। এর আগে কখনও কোথাও ওর ছবি ছাপা হয়নি তাই।
পরের দিন কলির ক্লাসের দ্বিতীয় হওয়া মেয়ে ডলিকে ছবি তোলার জন্যে নিয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কলি ভাবল তাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। কলি সাথে সাথে ক্লাস টিচারের কাছে গেলো....
- ম্যাডাম, আমার ক্লাসেতো আমি ফার্স্ট হলাম, কিন্তু উনাদের দেখলাম ডলিকে নিয়ে গেলো। ঠিক বুঝলাম না?
- হুম...দেখো কলি, এটাতো একটা ম্যাগাজিনের জন্যে। অনেক অনেক মানুষ দেখবে, বিভিন্ন মন্তব্য করবে। ভার্সিটির একটা বিজ্ঞাপনও বলতে পারো। সো, আমরা এখানে একটু সুন্দর মেয়ে.... বুঝতেই পারছো, আমি কি মিন করছি?
- জি ম্যাডাম, অবশ্যই। থ্যাঙ্ক ইউ।
আবার ভেঙ্গে পরল কলি। কষ্টের মাত্রাটা ওর কাছে এখন অসহনীয় মনে হচ্ছে। যেকোনো সময় সুইসাইড করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ক্লাসের সব চাইতে চতুর ছাত্রের নাম হচ্ছে আজিজ। ও ব্যাপারটা ঠিকই আন্ডাজ করল। সাধারণত ও কলির সাথে কখনও পড়ালেখার বাইরে কথা বলেনি, তবে এবার ভাবছে বলবে।
ক্যান্টিনে মন খারাপ করে বসে আছে কলি। আজিজ একটি চেয়ার নিয়ে ওর পাশে বসল।
-কিছু বলবে?
-কেন? কিছু না বলার হলে কি বসা যাবে না?
-না বসা যাবে।
-হুম...আচ্ছা কলি, তুমি কখনও কোন লিফলেট দেখেছো?
-হ্যাঁ, কিন্তু হটাৎ এই প্রশ্ন?
-আচ্ছা, মানুষ যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে এই লিফলেট পায় তার পর সেটা দিয়ে কি করে?
-কেউ ফেলে দেয়, কেউ প্রয়োজন মনে করলে সাথে রাখে।
-হুম.. তবে বেশির ভাগই ফেলে দেয়। আবার সেগুলো মানুষের পায়ের পারায় থাকতে থাকতে বিলীনও হয়ে যায়।
-হ্যাঁ, তো?
-তাহলে একবার ভেবে দেখতো, আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনও কিন্তু মানুষের হাতে হাতে যাবে। তখন যদি রাস্তায় মানুষের পায়ের নিচে তুমি সেই ম্যাগাজিনের কাগজ দেখতে পাও, আর যদি দেখো সেখানে তোমার ছবি, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে?
কলি আজিজের কথাগুলো বেশ ভালো ভাবেই হজম করে নিল। এবং আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা থেকে নিজেকে গুঁটিয়ে নিল।
কলির বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কয়েকদিন যাবত কলিকে আদর করে ভূতনী বলে ডাকে। কলি ঘুমাতে যাবার আগে চিন্তা করে আচ্ছা, স্যার আমাকে আদর করে পরীও তো ডাকতে পারতো, কিন্তু ভূতনী কেন? যাক, অনেক প্রশ্নের মত এই প্রশ্নেরও কোন সমাধান কলির জানা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টাডি ট্যুরে নিয়ে যাওয়া হল গাজীপুর। সকল বন্ধুরাই গ্রুপ ছবি তোলায় ব্যস্ত, অথচ কলিকে কেও একটি বারের জন্যেও ডাকে না। হটাৎ রফিক নামের ওর এক ক্লাস মেট ওকে ডাক দিল এবং....
-এই কলি, একটু এদিকে আসোতো।
-হ্যাঁ, বল।
-আমাদের সবার একটা ছবি তুলে দাও না।
-হুম...অবশ্যই।
কলির নিজেকে খুব একা একা মনে হতে লাগল। কেন এই একাকীত্ব?
কলি খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, ওর হাতের লেখাও ছিল খুব সুন্দর। ক্লাসের কোন উপস্থাপনা বা হাতের লেখার কাজ থাকলেই সবাই ওর কাছে আসতো। তবে এই ব্যাপারটা মোটেও সহ্য করতে পারতো না ডলি। একদিন ক্যান্টিনে কলি সহ সকলেই বসে আছে। হটাৎ কোন কারণ ছাড়াই ডলি কলিকে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে অপমান করতে লাগল। কলি চুপ থাকতেই ভালোবাসে। তাই, এবারো চুপ করে থেকে চলে গেলো। এবং একা একা কাঁদতে লাগল। কালিকে এবার সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। কলি আজ সত্যিই বড় একা।
ভার্সিটির জীবন শেষ কলির। ক্লাসে সবার মাঝে প্রথম হয়েই কলি অনার্স শেষ করল। এই চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কলিকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। শিখিয়েছে একাকীত্বের বিরুদ্ধে লড়াই, শিখিয়েছে প্রকৃত সৌন্দর্য কোথায় লুকিয়ে আছে।
সবাই আজ খুশি, খুশি হতে পারেনি শুধু ডলি। ডলির মনে একটাই প্রশ্ন, রূপ-সৌন্দর্য, শরীর কাঠামো সব দিক দিয়েইতো আমি কলির চাইতে এগিয়ে। তবে কেন এই বারো সেমিস্টারের একবারও কলিকে টপকিয়ে ফার্স্ট হতে পারলাম না?
পাঁচ বছর পেড়িয়ে গেলো। ডলি একটি ছোট-খাটো বেসরকারি স্কুলের টিচার। সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে বিনোদনের পাতাটাই ও আগে পরে। বিনোদনের পাতাটা খুলতেই চোখ থমকে গেলো ডলির। বেশ বড় করেই কলির ছবি ছাপানো হয়েছে। দেশ সেরা টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মর্যাদা পেয়েছে কলি। কলিযে একটা বেসরকারি টিভিতে কাজ করে তা ডলি জানত। আর তাই কখনও ওই চ্যানেল দেখত না ডলি। ফেসবুকেও কলিকে ব্লক করে রেখেছে ও। তবে আজ কেন যেন ডলি নিশ্চুপ। পত্রিকার পাতাটা আজ পরিবর্তন হচ্ছে না, চোখের মধ্যে আজ নেই কোন হিংসার প্রতিচ্ছবি। পাঁচ বছর আগে ওর মনের মধ্যে যেই প্রশ্নের উদ্গ্রেব হয়েছিল হয়ত আজ তার উত্তর খুঁজে পেয়েছে ডলি।
গায়ের ফর্সা রঙ অথবা আকর্ষণীয় শরীর কাঠামো যে আসলে কোন সৌন্দর্যই নয় আজ তা উপলব্ধি করতে পারছে ডলি। মনের সৌন্দর্যতা, অন্তরের পবিত্রতা, ভিতরের যোগ্যতা বা গুনাবলি দিয়েই যে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হয় আজ তা নিঃশব্দেই মেনে নিয়েছে ও।
কলি এখন অনেক সুখী। ওর ক্যারিয়ারও এখন তুঙ্গে। খুব শীঘ্রই ফারুকের সাথে বিয়ের পীড়িতে বসবে ও। ফারুক সেই ছেলে যে প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় কলির সাথে বাসে উঠত। ফারুক কলিকে তখন থেকেই ভালোবাসে কিন্তু ভীতু হওয়ায় কিছুই বলতে পারতো না। ফারুক কিন্তু কখনও কলির গায়ের রঙ দেখে ওকে অপছন্দ বা অগ্রাহ্য করেনি। কারণ ফারুক ঠিকই জানত যে ভালোবাসাটা মনের ব্যাপার, অন্তরের ব্যাপার। বাহ্যিক কাঠামো বিবেচনা করে সেটা হয় না। আর এমন সত্যিকারের প্রেমিককে আগলিয়ে নিতেও কেউ দেরি করে না।
লেখক: ওমর ফারুক কোমল
৯জুন, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস