পাঠকই লেখক ডেস্ক : দুদিন পর আপুর জন্মদিন। খুব সুন্দর কিছু একটা গিফট করতে চাই। কিন্তু কী দিব বুঝতে পারছি না। স্কুল ছুটি শেষে বন্ধু হাসানকে বললাম,
'মার্কেটে যাবি?'
'কেন?'
'একটা গিফট কিনব।'
'দোস্ত আজকে না। প্রচন্ড গরমে আমি ক্লান্ত। কাল বিকালে চল?'
'আচ্ছা। কাল বিকালে তোর বাসায় চলে আসব।'
হাসানকে বিদায় দিয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম।
বাসায় পৌঁছে কলিংবেল বাজালাম। আপু দরজা খুলে দিল। তারপর হাসি মুখে বলল,
'কিরে তনয়, আজ এত দেরী করলি যে?'
জুতা খুলতে খুলতে বললাম, 'আর বলো না আপু। এত গরমে রিকশায় পাওয়া যায় না।'
'আচ্ছা তুই বোস। আমি তোর জন্য শরবত এনে দিচ্ছি।'
ব্যাগটা শোফার উপর ফেলে ফ্যানটা ছেড়ে ধপাস করে শোফার উপর বসলাম। একটু পরেই আপু আমার জন্য শরবত করে আনলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললাম,
'ভার্সিটি থেকে কখন আসলা আপু?'
'তোর আসার পাঁচ মিনিট আগে। এসেই ভাত চড়িয়েছি।'
'কতবার বললাম শরবতে লেবু দিও না। তুমি আমার কথাই শোন না।'
'হিহি। আজকে খেয়ে নে। কাল থেকে আর দিব না।'
প্রতিদিন আপু একই কথা বলে। তারপরেও শরবতে লেবু দিবেই।
'এখন যা গোসল করে ফ্রেশ হ। আব্বু চলে আসবে। আমি ততক্ষণ খাবার রেডি করি।'
বাসার সব কাজ আপুই করে। মাঝে মাঝে আপুর দিকে অবাক হয়ে তাকাই। কিভাবে করে আপু? আমি যখন ক্লাস টু তে পড়ি তখন আমার মা মারা যায়। এখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আট বছর কেটে গেছে। মায়ের স্মৃতিগুলোও ভুলে গেছি। তখন থেকেই আপু আমাকে বড় করছে।
আব্বু ছোটখাট একটা চাকরি করে। মধ্যবিত্ত পরিবার। আব্বুর সামান্য বেতনে পরিবারটা চলছে এবং খুব ভালই চলছে। আমি, আপু আর আব্বু। ছিমছাম হাসিখুশি একটা পরিবার। বেশ কেটে যাচ্ছে।
২.
কাল আপুর জন্মদিন। ড্রয়ার খুলে আমার খাতার ভাঁজ থেকে কিছু টাকা বের করলাম। আপুর জন্য কিছু কিনব বলে অনেকদিন ধরেই টাকা জমাচ্ছি। প্রায় দুশো টাকা। এর মাঝেই ভাল কিছু কিনতে পারব আশা করি।
বিকাল পাঁচটা। রেডি হয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। হাসানের বাসায় গিয়ে তার সাথে মার্কেটে যাব। আপুর রুমে ঢুকে দেখি আপু শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। আমি বললাম,
'আপু দরজাটা লাগিয়ে দিও।'
'কোথায় যাচ্ছিস রে?'
'এইতো খেলতে যাচ্ছি।'
'আচ্ছা যা। সন্ধ্যার আগে চলে আসিস।'
'আচ্ছা।'
মিথ্যা কথা বলে বাসা থেকে বের হলাম। সত্যি কথা বলতে লজ্জা লাগছে তাই!
আমি আর হাসান মার্কেটে ঘুরছি। কিন্তু কেনার মত তেমন কিছু পেলাম না। হাসান আর আমি পছন্দ করে একটা কার্ড কিনলাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম। স্কুল শুরু হবে সাড়ে সাতটায়। আব্বু প্রতিদিন সকালে বারান্দায় বসে রবীন্দ্র সংগীত শোনেন। আর আপু ঘুমাচ্ছে। ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে গরম করে নিলাম। তারপর খেয়েদেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেলাম। যাওয়ার আগে আপুর রুমে টেবিলে কার্ডটা রেখে দিলাম।
কার্ডে লিখেছি, 'শুভ জন্মদিন, আপু।'
জন্মদিনের দিনটা প্রতিদিনের মতই। মনে হচ্ছে না আজ আপুর বার্থডে। নিশ্চয় আপু কার্ড পেয়ে অনেক খুশি। মুখে কিছু না বললেও বোঝা যায়। রাতে আব্বু যখন অফিস থেকে আসলো তখন আব্বুর হাতে দেখি কেকের ছোট্ট প্যাকেট। তারপর কী মজাটাই না হল! আপু কেক কেটে আব্বুকে খাইয়ে দিলেন। তারপর আমাকে খাইয়ে গালে মেখে দিলেন। আমিও বা কম কিসে! আমিও আপুর গালে কেক মাখিয়ে দিলাম।
৩.
খুব সুন্দর কাটছে দিনগুলো। দেখতে দেখতে আমার এসএসসি পরীক্ষা চলে এল। আপু তখন আমাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে গেল। একদিন ডিনার করার সময় আপুকে বললাম,
'আপু আমি কিন্তু সব জেনে গেছি।'
'কি জেনে গেছিস?'
'ইয়ে মানে দুলাভাইয়ের কথা বলছি।'
'এই ফাজিল কি বলিস এগুলা?'
'হ্যাঁ। তুমি যখন রান্নাঘরে ছিলে দুলাভাই তোমাকে কল দিয়েছিল। আমি তখন কথা বলেছিলাম।'
'দুলাভাই দুলাভাই করছিস কেন? আমরা কি বিয়ে করেছি নাকি?'
'ঐতো হবে একদিন। যাই হোক, উনাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। রসিক মানুষ।'
'হয়েছে। সামনে তোর পরীক্ষা। এখন ভাল করে পড়।'
আমি আপুর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলাম।
৪.
দেখতে দেখতে রেজাল্টের দিন চলে আসলো। আজ আমার রেজাল্ট। সকালে আপু আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলল।
'ঐ ওঠ। আজ তোর রেজাল্ট না?'
'ইশ আপু আরেকটু ঘুমাই না?'
'দশটা বাজে। আর কত ঘুমাবি? টেবিলে নাস্তা দেয়া আছে। খেয়েদেয়ে রেজাল্ট নিয়ে আয়। আজতো তোর খুশির দিন।'
'আমি ফেল করব।'
'তাই নাকি? ফেল করলে আজকেই তোর বিয়ে দিয়ে দিব। হিহি।'
'এই অফারটা আগে বলবা না?'
'আমি জানি তুই এ প্লাস পাবি। তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে। এখন উঠে রেডি হ।'
আপুর চোখেমুখে আমার স্বপ্ন দেখতে পেলাম। জানি না ভাগ্যে কী আছে? আপুর বিশ্বাস কি রাখতে পারব?
অবশেষে রাখতে পেরেছি। কল দিয়ে আপুকে যখন রেজাল্ট জানালাম তখন আপু চিৎকার দিয়ে উঠল। আমার চেয়ে আপুকেই বেশি খুশি মনে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে দেখলাম উত্সব উত্সব ভাব। আপু আমাকে মিষ্টি খাইয়ে দিল। আপুর চোখ ছলছল করছে। আনন্দের অশ্রু।
৫.
রেজাল্টের কয়েক মাস পর আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আজ ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে। যাকে দুলাভাই দুলাভাই বলে ডাকতাম সেই ছেলেটার সাথেই আপুর বিয়ে হচ্ছে। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। সামনের মাসে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হল।
ইদানিং আপুর মন খারাপ থাকে। কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে। একদিন আপুকে বললাম,
'তুমি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?'
'নারে ভাই। তোদের কথা চিন্তা করছি। আমি চলে গেলে তোকে কে দেখবে? বাবাকে কে দেখবে?'
'এত চিন্তা করলে হবে? আর তোমাকে বিদায় করতে পারলে শান্তি। অন্তত টিভি শান্তি করে দেখতে পারব। রিমোর্ট নিয়ে মারামারি করতে হবে না।'
'ও। খুব শান্তি না? দরকার হলে বিয়ের পর এখানেই থেকে যাব। তবুও তোকে শান্তিতে থাকতে দিব না।'
'হাহা। সেটা পরে দেখা যাবে। এখন খেতে চলো।'
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল। কাল আপুর বিয়ে। আজ আমার মন খারাপ লাগছে। আসলেই আমি একা হয়ে যাব। সব স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে। যখন আমি অসুস্থ থাকতাম তখন সারারাত আপু আমার পাশে জেগে থাকত। এখন অসুস্থ হলে কে থাকবে? কাল থেকে রিমোর্ট নিয়ে আর মারামারি হবে না, সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিবে না। বারান্দায় বসে এসবই ভাবছিলাম আমি।
৬.
বিয়েটা বেশ ধুমধাম ভাবে হয়েছিল। বিদায় বেলায় আপুর সে কী কান্না! আব্বুকে ধরে কাঁদছে তো কাঁদছেই। আব্বুকে ছেড়ে যখন আমার দিকে এগিয়ে আসলো তখন একটু হাসি দিল। আমাকে জড়িয়ে বলল,
'এবার তো তুই শান্তিতে থাকবি। আব্বুর প্রতি খেয়াল রাখিস। আর নিজের যত্ন নিস।'
বিয়ের প্রায় দুমাস কেটে গেল। আপু সেই আগের মতই আছে। চঞ্চল হাসিখুশি। প্রতিদিন আমার সাথে কথা বলতো। সারাদিন কি কি করছি সব শুনতো। মাঝে মাঝে সময় পেলে চলে আসত আমাদের বাসায়।
আজ আমার জন্মদিন। অথচ আপু আমাকে উইশ করেনি। ভীষণ রাগ লাগছে। বিয়ের পর এমনই হয়। আপু হয়তো ভুলেই গেছে।
কলেজ থেকে এসে আমি আর আব্বু একসাথে খেতে বসলাম। আব্বু বললেন,
'তনয় তোর জন্য একটা গিফট আছে।'
'কিসের?'
'জন্মদিনের। তোর আপু পাঠিয়েছে।'
'আপু? সত্যি?'
'হ্যাঁ রে। তোর ড্রয়ারে রেখেছি।'
আমি তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে রুমে আসলাম। ড্রয়ার খুলে প্যাকেট থেকে গিফটটা বের করলাম। একটা টেপ রেকর্ডার। আমি সেটা অন করলাম।
'হ্যাপি বার্থডে তনয়। অনেক ভালবাসি। অনেক ভালবাসি আমার ছোট দুষ্টু ভাইটাকে। তোর প্রতিটি দিন আনন্দে কাটুক। অনেক দোয়া রইল তোর জন্য। অনেক ভালবাসি আমার লক্ষ্মী ভাইটাকে। অনেক অনেক ভাল থাকিস ভাই আমার।'
রেকর্ডিংটা প্রায় চার পাঁচবার শুনলাম। আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ গিফট।
৭.
প্রায় চার বছর কেটে গেল। কলেজ পাশ করে এখন আমি ভার্সিটিতে পড়ি। খুলনা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম। সেখানেই মেসে থেকে পড়ছি।
দিনগুলো অনেক পাল্টে যাচ্ছে। ইদানিং আপুও অনেক কম কথা বলে। মাঝে মাঝে দেখে আসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পড়ালেখার ব্যস্ততার কারণে সময় বের করতে পারি না।
রাত নয়টা বাজে। মেসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এসময় আপু কল করে। কল ধরে বললাম,
'আসসালামুআলাইকুম আপু। কেমন আছ?'
'এইতো আছি ভালোই। কি করিস রে? খেয়েছিস?'
'না। একটু পরে খাবো। আপু তোমার কি হয়েছে বলবা? ইদানিং তুমি খুব কম কথা বলো! কণ্ঠও শুকনো। তুমি কি অসুস্থ?'
'নারে কিছু হয়নি। খেয়ে নিস। এখন রাখি।'
আপু কলটা কেটে দিল। আপুর কিছু একটা হয়েছে। আমার কাছে লুকাচ্ছে। আব্বু দুলাভাই কেউই আমাকে কিছু বলছে না।
পরদিন রাত দশটায় দুলাভাই আমাকে কল দিল।
'কী খবর দুলাভাই? এতদিন পর শালাবাবুকে মনে পড়ল?'
'একটা খবর আছে। বলব?'
'হুম বল।'
'আমাদের একটা মেয়ে হয়েছে। তুই মামা হয়ে গেছিস।'
'কি? সত্যি আমি মামা হয়ে গেছি? অভিনন্দন দুলাভাই। আপু কী করছে? আপুকে দাও।'
দুলাভাই চুপ। কোন কথা বলছে না। আমি আবার বললাম, 'কি হল দুলাভাই? আপুকে দাও।'
'তোর আপু আর নেই।'
একথা শুনে দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তি আমার ছিল না। বিছানায় বসে পড়লাম। কান্নাজড়িত কন্ঠে দুলাভাই কথা বলে যাচ্ছেন। আমি চুপচাপ শুনছি।
'ডাক্তার আগেই বলে দিয়েছিল যেকোন একজন বাঁচবে। হয় বাচ্চা না হলে তোর আপু। তোর আপুকে বলেছিলাম আমাদের সন্তান লাগবে না। কিন্তু সে আমার কথা শুনল না। তোকে আগে থেকে কেন বলা হয়নি জানিস? কারণ তুই কষ্ট পাবি। তোর আপু এটা দেখতে পারবে না। তাই আমাকে বলতে দেয়নি। কাল চলে আসিস তনয়। দুপুরে কবর দেয়া হবে।'
সারারাত আমার ঘুম হল না। আপুর রেকর্ডিংটা বারবার শুনছি। আমি কাঁদছি। আপু তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি? কেন?
পরদিন খুব সকালের ট্রেন ধরলাম। আপুর দেয়া পান্জাবীটা পড়লাম। গত ঈদে আপু এটা দিয়েছিল। আজ আর কাঁদব না। আজ খুশির দিন। আমি মামা হয়েছি।
বাসায় পৌঁছালাম প্রায় দুপুরের দিকে। সব আত্নীয়স্বজন চলে এসছে। চারিদিকে কান্নার রোল! কফিনে রাখা লাশটা আমি দেখিনি। আব্বু মানা করলেন। বললেন, 'তোর স্মৃতিতে বেঁচে আছে তোর আপু। তুই চোখ বন্ধ করলেই সেই হাসিখুশি মুখটা ভেসে উঠবে। সেটাই থাকুক না?'
আমি কিছু বললাম না। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
কবর দেয়া শেষে আমরা হাসপাতালে গেলাম। পিচ্চিটা তার দাদীর কোলে। আমি পিচ্চিকে কোলে তুলে নিলাম। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। পিচ্চিটা দেখতে হুবুহু আমার আপুর মত। হ্যাঁ একদম আমার আপুর মত। দুলাভাইকে বললাম, 'দেখো দেখো পিচ্চিটা দেখতে একদম আমার আপুর মত।'
আমার দিকে তাকিয়ে দুলাভাই হাসি দিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ রে। একদম তোর আপুর মত।' আমিও দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত একটা হাসি দিলাম।
লেখক: আর জে কুবের মাঝি
৮ এপ্রিল,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস